This is featured post 1 title
Replace these every slider sentences with your featured post descriptions.Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha - Premiumbloggertemplates.com.
This is featured post 2 title
Replace these every slider sentences with your featured post descriptions.Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha - Premiumbloggertemplates.com.
This is featured post 3 title
Replace these every slider sentences with your featured post descriptions.Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these with your own descriptions.This theme is Bloggerized by Lasantha - Premiumbloggertemplates.com.
Sunday, November 18, 2012
4:10 PM
Amit Das
আমি আজকে দেখলাম মানুষ কি ভাবে ঘুষ এর টাকা চাই। আজকে কাউনসিল অফিস থেকে এক ব্যক্তি এসে বলে আপনাদের পাকা বাড়িটি কত দিনের তৈরি বললাম ১৫ বছর। ১৫ বছরের খাজনা তো অনের টাকা আসে প্রাই ২০০০ হাজার টাকা এবং ১৫ বছরের সুদের সুদ অনেক টাক। তবে আমাকে যদি আপনি ২০০ টাকা দেন তাহলে আমি আপনার বাড়ি টি ১৫ বছর এর জাইগায় ৫ বছর করে দেব। তাহলে হিসাব করে দেখুন ঐ ব্যক্তির মাসিক ঘুষ খাওয়ার ইনকাম কত। প্রতি বাড়ি থেকে সে এই ভাবে ঘুষ চাচ্ছে এবং খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরাও ঘুষ দিয়ে যাচ্ছি।
Friday, October 26, 2012
11:28 PM
Amit Das
বরাবরের মতো এবারো বরাতিয়া গ্রামে সার্বজনীন দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে। এই দুর্গা পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন গান বাজনা, কুইজ প্রতিযোগিতা ও নাটক মঞ্চস্থের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হল এই দুর্গা পূজা। পরে এক প্রীতি ফুট বল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হল এই উৎসব।
Amit DAs
Amit DAs
Sunday, October 14, 2012
5:15 PM
Amit Das
লালসালু উপন্যাসের নামকরণ
নামকরণ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাধারণত বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ইত্যাদি নামকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালূ একটি বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসের নামকরলের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর অন্তনিহিত তাৎপর্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
লালসালূ হচ্ছে লাল রঙের কাপড়। এমনিতে লাল কাপড়ের তেমন কোনো মহিমা নেই। তবে এটি খুব উজ্জ্বল রং হওয়ায় একে বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যায়। বাংলাদেশের এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী যুগ-যুগ ধরে লাল রংটিকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। কবরের উপর লাল কাপড় বিছিয়ে দিলে কবরের গুরুত্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন তা আর সাধারণ কবরে সীমাবদ্ধ থাকে না_মাজারে পরিণত হয়। কবরটি তখন মানুষের ভক্তিপ্রীতির আকর্ষণ হয়ে দাড়ায়। এ ধরনের কবরে মানুষ প্রতিনিয়ত ভিড় জমায়, জেয়ারত করে, দোয়া দরুদ পড়ে এবং শিরনি দেয়। টাকা পয়সা দেয়। এভাবে মাজারটি হয়ে দাড়ায় পরলোক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এই মাজার বাংলাদেশের লোকজীবনে অসামান্য প্রভাব ফেলে। এখানেই লালসালু নামকরণের তৎপর্য ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে। এর সাথে পীর-ফকিরদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের প্রতি দুর্বল। এক সময় এদেশে পীর-ফকিরদের আধিপত্য ছিল। বর্তমানে সেরকম আধিপত্য না থাকলেও পীরভক্তি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। খানকা শরিফ, দরগা, মাজার এদেশের বিশাল লোকজীবনে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা আর কুসংস্কার জমাট বেধে আছে। পীর-ফকিরদের প্রতি ভক্তি-বিশ্বাসের মূল আছে অশিক্ষা আর কুসংস্কার। মানুষের ধারণা, পীর-ফকিরেরা আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান, সৃষ্টিকর্তার নৈকট্যে তারা আছে, কাজেই তাদের মুরিদ হয়ে তাদের সেবাযত্ন করতে পারলে পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে। এসব কারলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতাকে পুজি করে ভণ্ড ধার্মিকেরা ধর্মব্যবসায়ে নেমে পড়ে। তাদের কর্মতপরতার মধ্যে রয়েছে কবরকে কারুকার্যমণ্ডিত ঝালরওয়ালা লাল রঙের কাপড়ে আব্রত করে মাজারে পরিণত করা এবং তার মধ্যে দিয়ে দুনিয়াদারি হাসিল করা। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র এ ধরনের ব্যবসার জমজমাট পরিবেশ দেখা যায়। এভাবে লালসালূ হয়ে পড়েছে ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রতীক।
নামকরণ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাধারণত বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ইত্যাদি নামকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালূ একটি বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসের নামকরলের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর অন্তনিহিত তাৎপর্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
লালসালূ হচ্ছে লাল রঙের কাপড়। এমনিতে লাল কাপড়ের তেমন কোনো মহিমা নেই। তবে এটি খুব উজ্জ্বল রং হওয়ায় একে বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যায়। বাংলাদেশের এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী যুগ-যুগ ধরে লাল রংটিকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। কবরের উপর লাল কাপড় বিছিয়ে দিলে কবরের গুরুত্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন তা আর সাধারণ কবরে সীমাবদ্ধ থাকে না_মাজারে পরিণত হয়। কবরটি তখন মানুষের ভক্তিপ্রীতির আকর্ষণ হয়ে দাড়ায়। এ ধরনের কবরে মানুষ প্রতিনিয়ত ভিড় জমায়, জেয়ারত করে, দোয়া দরুদ পড়ে এবং শিরনি দেয়। টাকা পয়সা দেয়। এভাবে মাজারটি হয়ে দাড়ায় পরলোক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এই মাজার বাংলাদেশের লোকজীবনে অসামান্য প্রভাব ফেলে। এখানেই লালসালু নামকরণের তৎপর্য ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে। এর সাথে পীর-ফকিরদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের প্রতি দুর্বল। এক সময় এদেশে পীর-ফকিরদের আধিপত্য ছিল। বর্তমানে সেরকম আধিপত্য না থাকলেও পীরভক্তি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। খানকা শরিফ, দরগা, মাজার এদেশের বিশাল লোকজীবনে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা আর কুসংস্কার জমাট বেধে আছে। পীর-ফকিরদের প্রতি ভক্তি-বিশ্বাসের মূল আছে অশিক্ষা আর কুসংস্কার। মানুষের ধারণা, পীর-ফকিরেরা আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান, সৃষ্টিকর্তার নৈকট্যে তারা আছে, কাজেই তাদের মুরিদ হয়ে তাদের সেবাযত্ন করতে পারলে পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে। এসব কারলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতাকে পুজি করে ভণ্ড ধার্মিকেরা ধর্মব্যবসায়ে নেমে পড়ে। তাদের কর্মতপরতার মধ্যে রয়েছে কবরকে কারুকার্যমণ্ডিত ঝালরওয়ালা লাল রঙের কাপড়ে আব্রত করে মাজারে পরিণত করা এবং তার মধ্যে দিয়ে দুনিয়াদারি হাসিল করা। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র এ ধরনের ব্যবসার জমজমাট পরিবেশ দেখা যায়। এভাবে লালসালূ হয়ে পড়েছে ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রতীক।
Wednesday, October 3, 2012
3:48 PM
Amit Das
উপন্যাসঃ
চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর )
১
বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িল। দুই জনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন।
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ধরিয়া পড়িলেন, “বাবা মহিন, গরিবের মেয়েটিকে উদ্ধার করিতে হইবে। শুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছে– তোদের আজকালকার পছন্দর সঙ্গে মিলিবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “মা, আজকালকার ছেলে তো আমি ছাড়াও আরো ঢের আছে।”
রাজলক্ষ্মী। মহিন, ঐ তোর দোষ, তোর কাছে বিয়ের কথাটি পাড়িবার জো নাই।
মহেন্দ্র। মা , ও কথাটা বাদ দিয়াও সংসারে কথার অভাব হয় না। অতএব ওটা মারাত্মক দোষ নয়।
মহেন্দ্র শৈশবেই পিতৃহীন। মা-সম্বন্ধে তাহার ব্যবহার সাধারণ লোকের মতো ছিল না। বয়স প্রায় বাইশ হইল, এম. এ. পাস করিয়া ডাক্তারি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, তবু মাকে লইয়া তাহার প্রতিদিন মান-অভিমান আদর-আবদারের অন্ত ছিল না। কাঙারু-শাবকের মতো মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াও মাতার বহির্গর্ভের থলিটির মধ্যে আবৃত থাকাই তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। মার সাহায্য ব্যতীত তাহার আহার বিহার আরাম বিরাম কিছুই সম্পন্ন হইবার জো ছিল না।
এবারে মা যখন বিনোদিনীর জন্য তাহাকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িলেন, তখন মহেন্দ্র বলিল, “আচ্ছা, কন্যাটি একবার দেখিয়া আসি।”
দেখিতে যাইবার দিন বলিল, “দেখিয়া আর কী হইবে। তোমাকে খুশি করিবার জন্য বিবাহ করিতেছি, ভালোমন্দ বিচার মিথ্যা।”
কথাটার মধ্যে একটু রাগের উত্তাপ ছিল, কিন্তু মা ভাবিলেন, শুভদৃষ্টির সময় তাঁহার পছন্দর সহিত যখন পুত্রের পছন্দর নিশ্চয় মিল হইবে তখন মহেন্দ্রের কড়ি-সুর কোমল হইয়া আসিবে।
রাজলক্ষ্মী নিশ্চিন্তচিত্তে বিবাহের দিন স্থির করিলেন। দিন যত নিকটে আসিতে লাগিল, মহেন্দ্রের মন ততই উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল– অবশেষে দুই-চার দিন আগে সে বলিয়া বসিল, “না মা, আমি কিছুতেই পারিব না।”
বাল্যকাল হইতে মহেন্দ্র দেবতা ও মানবের কাছে সর্বপ্রকারে প্রশ্রয় পাইয়াছে, এইজন্য তাহার ইচ্ছার বেগ উচ্ছৃঙ্খল। পরের ইচ্ছার চাপ সে সহিতে পারে না। তাহাকে নিজের প্রতিজ্ঞা এবং পরের অনুরোধ একান্ত বাধ্য করিয়া তুলিয়াছে বলিয়াই বিবাহ-প্রস্তাবের প্রতি তাহার অকারণ বিতৃষ্ণা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল এবং আসন্নকালে সে একেবারেই বিমুখ হইয়া বসিল।
মহেন্দ্রের পরম বন্ধু ছিল বিহারী; সে মহেন্দ্রকে দাদা এবং মহেন্দ্রের মাকে মা বলিত। মা তাহাকে স্টীমবোটের পশ্চাতে আবদ্ধ গাধাবোটের মতো মহেন্দ্রের একটি আবশ্যক ভারবহ আসবাবের স্বরূপ দেখিতেন ও সেই হিসাবে মমতাও করিতেন। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বলিলেন, “বাবা, এ কাজ তো তোমাকেই করিতে হয়, নহিলে গরিবের মেয়ে– ”
বিহারী জোড়হাত করিয়া কহিল, “মা, ঐটে পারিব না। যে-মেঠাই তোমার মহেন্দ্র ভালো লাগিল না বলিয়া রাখিয়া দেয়, সে-মেঠাই তোমার অনুরোধে পড়িয়া আমি অনেক খাইয়াছি, কিন্তু কন্যার বেলা সেটা সহিবে না।”
রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘বিহারী আবার বিয়ে করিবে ! ও কেবল মহিনকে লইয়াই আছে, বউ আনিবার কথা মনেও স্থান দেয়
না।’
এই ভাবিয়া বিহারীর প্রতি তাঁহার কৃপামিশ্রিত মমতা আর-একটুখানি বাড়িল।
বিনোদিনীর বাপ বিশেষ ধনী ছিল না, কিন্তু তাহার একমাত্র কন্যাকে সে মিশনারি মেম রাখিয়া বহুযত্নে পড়াশুনা ও কারুকার্য শিখাইয়াছিল। কন্যার বিবাহের বয়স ক্রমেই বহিয়া যাইতেছি, তবু তাহার হুঁশ ছিল না। অবশেষে তাহার মৃত্যুর পরে বিধবা মাতা পাত্র খুঁজিয়া অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। টাকাকড়িও নাই, কন্যার বয়সও অধিক।
তখন রাজলক্ষ্মী তাঁহার জন্মভূমি বারাসতের গ্রামসম্পর্কীয় এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সহিত উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ দেওয়াইলেন।
অনতিকাল পরে কন্যা বিধবা হইল। মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাগ্যে বিবাহ করি নাই, স্ত্রী বিধবা হইলে তো এক দণ্ডও টিকিতে পারিতাম না।”
বছর-তিনেক পরে আর-এক দিন মাতাপুত্রে কথা হইতেছিল।
“বাবা, লোকে যে আমাকেই নিন্দা করে।”
“কেন মা, লোকের তুমি কী সর্বনাশ করিয়াছ?”
“পাছে বউ আসিলে ছেলে পর হইয়া যায়, এই ভয়ে তোর বিবাহ দিতেছি না, লোকে এইরূপ বলাবলি করে।”
মহেন্দ্র কহিল, “ভয় তো হওয়াই উচিত। আমি মা হইলে প্রাণ ধরিয়া ছেলের বিবাহ দিতে পারিতাম না। লোকের নিন্দা মাথা পাতিয়া লইতাম।”
মা হাসিয়া কহিলেন, “শোনো একবার ছেলের কথা শোনো।”
মহেন্দ্র কহিল, “বউ আসিয়া তো ছেলেকে জুড়িয়া বসেই। তখন এত কষ্টের এত স্নেহের মা কোথায় সরিয়া যায়, এ যদি-বা তোমার ভালো লাগে, আমার ভালো লাগে না।”
রাজলক্ষ্মী মনে মনে পুলকিত হইয়া তাঁহার সদ্যসমাগতা বিধবা জাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “শোনো ভাই মেজোবউ, মহিন কী বলে শোনো। বউ পাছে মাকে ছাড়াইয়া উঠে, এই ভয়ে ও বিয়ে করিতে চায় না। এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কখনো শুনিয়াছ?”
কাকী কহিলেন, “এ তোমার, বাছা, বাড়াবাড়ি। যখনকার যা তখন তাই শোভা পায়। এখন মার আঁচল ছাড়িয়া বউ লইয়া ঘরকন্না করিবার সময় আসিয়াছে, এখন ছোটো ছেলেটির মতো ব্যবহার দেখিলে লজ্জা বোধ হয়।”
এ কথা রাজলক্ষ্মীর ঠিক মধুর লাগিল না এবং এই প্রসঙ্গে তিনি যে-কটি কথা বলিলেন, তাহা সরল হইতে পারে, কিন্তু মধুমাখা নহে। কহিলেন, “আমার ছেলে যদি অন্যের ছেলেদের চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে, তোমার তাতে লজ্জা করে কেন মেজোবউ। ছেলে থাকিলে ছেলের মর্ম বুঝিতে।”
রাজলক্ষ্মী মনে করিলেন, পুত্রসৌভাগ্যবতীকে পুত্রহীনা ঈর্ষা করিতেছে।
মেজোবউ কহিলেন, “তুমিই বউ আনিবার কথা পাড়িলে বলিয়া কথাটা উঠিল, নহিলে আমার অধিকার কী।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার ছেলে যদি বউ না আনে, তোমার বুকে তাতে শেল বেঁধে কেন। বেশ তো, এতদিন যদি ছেলেকে মানুষ করিয়া আসিতে পারি, এখনো উহাকে দেখিতে শুনিতে পারিব, আর কাহারো দরকার হইবে না।”
মেজোবউ অশ্রুপাত করিয়া নীরবে চলিয়া গেলেন। মহেন্দ্র মনে মনে আঘাত পাইল এবং কালেজ হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়াই তাহার কাকীর ঘরে উপস্থিত হইল।
কাকী তাহাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহার মধ্যে স্নেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ইহা সে নিশ্চয় জানিত। এবং ইহাও তাহার জানা ছিল, কাকীর একটি পিতৃমাতৃহীনা বোনঝি আছে, এবং মহেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া সন্তানহীনা বিধবা কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে কাছে আনিয়া সুখী দেখিতে চান। যদিচ বিবাহে সে নারাজ, তবু কাকীর এই মনোগত ইচ্ছাটি তাহার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলিয়া মনে হইত।
মহেন্দ্র তাঁহার ঘরে যখন গেল, তখন বেলা আর বড়ো বাকি নাই। কাকী অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের কাটা জানালার গরাদের উপর মাথা রাখিয়া শুষ্কবিমর্ষমুখে বসিয়াছিলেন। পাশের ঘরে ভাত ঢাকা পড়িয়া আছে, এখনো স্পর্শ করেন নাই।
অল্প কারণেই মহেন্দ্রের চোখে জল আসিত। কাকীকে দেখিয়া তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। কাছে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে ডাকিল, “কাকীমা।”
অন্নপূর্ণা হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “আয় মহিন, বোস।”
মহেন্দ্র কহিল, “ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে, প্রসাদ খাইতে চাই।”
অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝিয়া উচ্ছ্বসিত অশ্রু কষ্টে সংবরণ করিলেন এবং নিজে খাইয়া মহেন্দ্রকে খাওয়াইলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয় তখন করুণায় আর্দ্র ছিল। কাকীকে সান্ত্বনা দিবার জন্য আহারান্তে হঠাৎ মনের ঝোঁকে বলিয়া বসিল, “কাকী, তোমার সেই-যে বোনঝির কথা বলিয়াছিলে, তাহাকে একবার দেখাইবে না?”
কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে ভীত হইয়া পড়িল।
অন্নপূর্ণা হাসিয়া কহিলেন, “তোর আবার বিবাহে মন গেল নাকি, মহিন।”
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “না, আমার জন্য নয় কাকী, আমি বিহারীকে রাজি করিয়াছি। তুমি দেখিবার দিন ঠিক করিয়া দাও।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আহা, তাহার কি এমন ভাগ্য হইবে। বিহারীর মতো ছেলে কি তাহার কপালে আছে।”
কাকীর ঘর হইতে বাহির হইয়া মহেন্দ্র দ্বারের কাছে আসিতেই মার সঙ্গে দেখা হইল। রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী মহেন্দ্র, এতক্ষণ তোদের কী পরামর্শ হইতেছিল।”
মহেন্দ্র কহিল, “পরামর্শ কিছুই না, পান লইতে আসিয়াছি।”
মা কহিলেন, “তোর পান তো আমার ঘরে সাজা আছে।”
মহেন্দ্র উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া অন্নপূর্ণার রোদনস্ফীত চক্ষু দেখিবামাত্র অনেক কথা কল্পনা করিয়া লইলেন।
ফোঁস করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কী গো মেজোঠাকরুন, ছেলের কাছে লাগালাগি করিতেছিলে বুঝি?”
বলিয়া উত্তরমাত্র না শুনিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন।
বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িল। দুই জনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন।
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ধরিয়া পড়িলেন, “বাবা মহিন, গরিবের মেয়েটিকে উদ্ধার করিতে হইবে। শুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছে– তোদের আজকালকার পছন্দর সঙ্গে মিলিবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “মা, আজকালকার ছেলে তো আমি ছাড়াও আরো ঢের আছে।”
রাজলক্ষ্মী। মহিন, ঐ তোর দোষ, তোর কাছে বিয়ের কথাটি পাড়িবার জো নাই।
মহেন্দ্র। মা , ও কথাটা বাদ দিয়াও সংসারে কথার অভাব হয় না। অতএব ওটা মারাত্মক দোষ নয়।
মহেন্দ্র শৈশবেই পিতৃহীন। মা-সম্বন্ধে তাহার ব্যবহার সাধারণ লোকের মতো ছিল না। বয়স প্রায় বাইশ হইল, এম. এ. পাস করিয়া ডাক্তারি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, তবু মাকে লইয়া তাহার প্রতিদিন মান-অভিমান আদর-আবদারের অন্ত ছিল না। কাঙারু-শাবকের মতো মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াও মাতার বহির্গর্ভের থলিটির মধ্যে আবৃত থাকাই তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। মার সাহায্য ব্যতীত তাহার আহার বিহার আরাম বিরাম কিছুই সম্পন্ন হইবার জো ছিল না।
এবারে মা যখন বিনোদিনীর জন্য তাহাকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িলেন, তখন মহেন্দ্র বলিল, “আচ্ছা, কন্যাটি একবার দেখিয়া আসি।”
দেখিতে যাইবার দিন বলিল, “দেখিয়া আর কী হইবে। তোমাকে খুশি করিবার জন্য বিবাহ করিতেছি, ভালোমন্দ বিচার মিথ্যা।”
কথাটার মধ্যে একটু রাগের উত্তাপ ছিল, কিন্তু মা ভাবিলেন, শুভদৃষ্টির সময় তাঁহার পছন্দর সহিত যখন পুত্রের পছন্দর নিশ্চয় মিল হইবে তখন মহেন্দ্রের কড়ি-সুর কোমল হইয়া আসিবে।
রাজলক্ষ্মী নিশ্চিন্তচিত্তে বিবাহের দিন স্থির করিলেন। দিন যত নিকটে আসিতে লাগিল, মহেন্দ্রের মন ততই উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল– অবশেষে দুই-চার দিন আগে সে বলিয়া বসিল, “না মা, আমি কিছুতেই পারিব না।”
বাল্যকাল হইতে মহেন্দ্র দেবতা ও মানবের কাছে সর্বপ্রকারে প্রশ্রয় পাইয়াছে, এইজন্য তাহার ইচ্ছার বেগ উচ্ছৃঙ্খল। পরের ইচ্ছার চাপ সে সহিতে পারে না। তাহাকে নিজের প্রতিজ্ঞা এবং পরের অনুরোধ একান্ত বাধ্য করিয়া তুলিয়াছে বলিয়াই বিবাহ-প্রস্তাবের প্রতি তাহার অকারণ বিতৃষ্ণা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল এবং আসন্নকালে সে একেবারেই বিমুখ হইয়া বসিল।
মহেন্দ্রের পরম বন্ধু ছিল বিহারী; সে মহেন্দ্রকে দাদা এবং মহেন্দ্রের মাকে মা বলিত। মা তাহাকে স্টীমবোটের পশ্চাতে আবদ্ধ গাধাবোটের মতো মহেন্দ্রের একটি আবশ্যক ভারবহ আসবাবের স্বরূপ দেখিতেন ও সেই হিসাবে মমতাও করিতেন। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বলিলেন, “বাবা, এ কাজ তো তোমাকেই করিতে হয়, নহিলে গরিবের মেয়ে– ”
বিহারী জোড়হাত করিয়া কহিল, “মা, ঐটে পারিব না। যে-মেঠাই তোমার মহেন্দ্র ভালো লাগিল না বলিয়া রাখিয়া দেয়, সে-মেঠাই তোমার অনুরোধে পড়িয়া আমি অনেক খাইয়াছি, কিন্তু কন্যার বেলা সেটা সহিবে না।”
রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘বিহারী আবার বিয়ে করিবে ! ও কেবল মহিনকে লইয়াই আছে, বউ আনিবার কথা মনেও স্থান দেয়
না।’
এই ভাবিয়া বিহারীর প্রতি তাঁহার কৃপামিশ্রিত মমতা আর-একটুখানি বাড়িল।
বিনোদিনীর বাপ বিশেষ ধনী ছিল না, কিন্তু তাহার একমাত্র কন্যাকে সে মিশনারি মেম রাখিয়া বহুযত্নে পড়াশুনা ও কারুকার্য শিখাইয়াছিল। কন্যার বিবাহের বয়স ক্রমেই বহিয়া যাইতেছি, তবু তাহার হুঁশ ছিল না। অবশেষে তাহার মৃত্যুর পরে বিধবা মাতা পাত্র খুঁজিয়া অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। টাকাকড়িও নাই, কন্যার বয়সও অধিক।
তখন রাজলক্ষ্মী তাঁহার জন্মভূমি বারাসতের গ্রামসম্পর্কীয় এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সহিত উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ দেওয়াইলেন।
অনতিকাল পরে কন্যা বিধবা হইল। মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাগ্যে বিবাহ করি নাই, স্ত্রী বিধবা হইলে তো এক দণ্ডও টিকিতে পারিতাম না।”
বছর-তিনেক পরে আর-এক দিন মাতাপুত্রে কথা হইতেছিল।
“বাবা, লোকে যে আমাকেই নিন্দা করে।”
“কেন মা, লোকের তুমি কী সর্বনাশ করিয়াছ?”
“পাছে বউ আসিলে ছেলে পর হইয়া যায়, এই ভয়ে তোর বিবাহ দিতেছি না, লোকে এইরূপ বলাবলি করে।”
মহেন্দ্র কহিল, “ভয় তো হওয়াই উচিত। আমি মা হইলে প্রাণ ধরিয়া ছেলের বিবাহ দিতে পারিতাম না। লোকের নিন্দা মাথা পাতিয়া লইতাম।”
মা হাসিয়া কহিলেন, “শোনো একবার ছেলের কথা শোনো।”
মহেন্দ্র কহিল, “বউ আসিয়া তো ছেলেকে জুড়িয়া বসেই। তখন এত কষ্টের এত স্নেহের মা কোথায় সরিয়া যায়, এ যদি-বা তোমার ভালো লাগে, আমার ভালো লাগে না।”
রাজলক্ষ্মী মনে মনে পুলকিত হইয়া তাঁহার সদ্যসমাগতা বিধবা জাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “শোনো ভাই মেজোবউ, মহিন কী বলে শোনো। বউ পাছে মাকে ছাড়াইয়া উঠে, এই ভয়ে ও বিয়ে করিতে চায় না। এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কখনো শুনিয়াছ?”
কাকী কহিলেন, “এ তোমার, বাছা, বাড়াবাড়ি। যখনকার যা তখন তাই শোভা পায়। এখন মার আঁচল ছাড়িয়া বউ লইয়া ঘরকন্না করিবার সময় আসিয়াছে, এখন ছোটো ছেলেটির মতো ব্যবহার দেখিলে লজ্জা বোধ হয়।”
এ কথা রাজলক্ষ্মীর ঠিক মধুর লাগিল না এবং এই প্রসঙ্গে তিনি যে-কটি কথা বলিলেন, তাহা সরল হইতে পারে, কিন্তু মধুমাখা নহে। কহিলেন, “আমার ছেলে যদি অন্যের ছেলেদের চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে, তোমার তাতে লজ্জা করে কেন মেজোবউ। ছেলে থাকিলে ছেলের মর্ম বুঝিতে।”
রাজলক্ষ্মী মনে করিলেন, পুত্রসৌভাগ্যবতীকে পুত্রহীনা ঈর্ষা করিতেছে।
মেজোবউ কহিলেন, “তুমিই বউ আনিবার কথা পাড়িলে বলিয়া কথাটা উঠিল, নহিলে আমার অধিকার কী।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার ছেলে যদি বউ না আনে, তোমার বুকে তাতে শেল বেঁধে কেন। বেশ তো, এতদিন যদি ছেলেকে মানুষ করিয়া আসিতে পারি, এখনো উহাকে দেখিতে শুনিতে পারিব, আর কাহারো দরকার হইবে না।”
মেজোবউ অশ্রুপাত করিয়া নীরবে চলিয়া গেলেন। মহেন্দ্র মনে মনে আঘাত পাইল এবং কালেজ হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়াই তাহার কাকীর ঘরে উপস্থিত হইল।
কাকী তাহাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহার মধ্যে স্নেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ইহা সে নিশ্চয় জানিত। এবং ইহাও তাহার জানা ছিল, কাকীর একটি পিতৃমাতৃহীনা বোনঝি আছে, এবং মহেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া সন্তানহীনা বিধবা কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে কাছে আনিয়া সুখী দেখিতে চান। যদিচ বিবাহে সে নারাজ, তবু কাকীর এই মনোগত ইচ্ছাটি তাহার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলিয়া মনে হইত।
মহেন্দ্র তাঁহার ঘরে যখন গেল, তখন বেলা আর বড়ো বাকি নাই। কাকী অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের কাটা জানালার গরাদের উপর মাথা রাখিয়া শুষ্কবিমর্ষমুখে বসিয়াছিলেন। পাশের ঘরে ভাত ঢাকা পড়িয়া আছে, এখনো স্পর্শ করেন নাই।
অল্প কারণেই মহেন্দ্রের চোখে জল আসিত। কাকীকে দেখিয়া তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। কাছে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে ডাকিল, “কাকীমা।”
অন্নপূর্ণা হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “আয় মহিন, বোস।”
মহেন্দ্র কহিল, “ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে, প্রসাদ খাইতে চাই।”
অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝিয়া উচ্ছ্বসিত অশ্রু কষ্টে সংবরণ করিলেন এবং নিজে খাইয়া মহেন্দ্রকে খাওয়াইলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয় তখন করুণায় আর্দ্র ছিল। কাকীকে সান্ত্বনা দিবার জন্য আহারান্তে হঠাৎ মনের ঝোঁকে বলিয়া বসিল, “কাকী, তোমার সেই-যে বোনঝির কথা বলিয়াছিলে, তাহাকে একবার দেখাইবে না?”
কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে ভীত হইয়া পড়িল।
অন্নপূর্ণা হাসিয়া কহিলেন, “তোর আবার বিবাহে মন গেল নাকি, মহিন।”
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “না, আমার জন্য নয় কাকী, আমি বিহারীকে রাজি করিয়াছি। তুমি দেখিবার দিন ঠিক করিয়া দাও।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আহা, তাহার কি এমন ভাগ্য হইবে। বিহারীর মতো ছেলে কি তাহার কপালে আছে।”
কাকীর ঘর হইতে বাহির হইয়া মহেন্দ্র দ্বারের কাছে আসিতেই মার সঙ্গে দেখা হইল। রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী মহেন্দ্র, এতক্ষণ তোদের কী পরামর্শ হইতেছিল।”
মহেন্দ্র কহিল, “পরামর্শ কিছুই না, পান লইতে আসিয়াছি।”
মা কহিলেন, “তোর পান তো আমার ঘরে সাজা আছে।”
মহেন্দ্র উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া অন্নপূর্ণার রোদনস্ফীত চক্ষু দেখিবামাত্র অনেক কথা কল্পনা করিয়া লইলেন।
ফোঁস করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কী গো মেজোঠাকরুন, ছেলের কাছে লাগালাগি করিতেছিলে বুঝি?”
বলিয়া উত্তরমাত্র না শুনিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন।
3:43 PM
Amit Das
RE: উপন্যাসঃ
চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর )
২
মেয়ে দেখিবার কথা মহেন্দ্র প্রায় ভুলিয়াছিল, অন্নপূর্ণা ভোলেন নাই। তিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জেঠার বাড়িতে পত্র লিখিয়া দেখিতে যাইবার দিন স্থির করিয়া পাঠাইলেন।
দিন স্থির হইয়াছে শুনিয়াই মহেন্দ্র কহিল, “এত তাড়াতাড়ি কাজটা করিলে কেন কাকী। এখনো বিহারীকে বলাই হয় নাই।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি হয় মহিন। এখন না দেখিতে গেলে তাহারা কী মনে করিবে।”
মহেন্দ্র বিহারীকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল। কহিল, “চলো তো, পছন্দ না হইলে তো তোমার উপর জোর চলিবে না।”
বিহারী কহিল, “সে কথা বলিতে পারি না। কাকীর বোনঝিকে দেখিতে গিয়া পছন্দ হইল না বলা আমার মুখ দিয়া আসিবে না।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো উত্তম কথা।”
বিহারী কহিল, “কিন্তু তোমার পক্ষে অন্যায় কাজ হইয়াছে মহিনদা। নিজেকে হালকা রাখিয়া পরের স্কন্ধে এরূপ ভার চাপানো তোমার উচিত হয় নাই। এখন কাকীর মনে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে বড়োই কঠিন হইবে।”
মহেন্দ্র একটু লজ্জিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল, “তবে কী করিতে চাও।”
বিহারী কহিল, “যখন তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহাকে আশা দিয়াছ, তখন আমি বিবাহ করিব– দেখিতে যাইবার ভড়ং করিবার দরকার নাই।”
অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত।
অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি পছন্দ না হয়, তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল।”
নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও।”
মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি।”
মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে বলিব।”
মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরের জন্য হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ ঢালে।
দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল।
কন্যার জেঠা শ্যামবাজারের অনুকূলবাবু– নিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায় তাঁহার বাগানসমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর তুলিয়াছেন।
দরিদ্র ভ্রাতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পুত্রীকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেন। মাসি অন্নপূর্ণা বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে থাক্।” তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকূল রাজি হইলেন না। এমন-কি, দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া ছিলেন।
কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল কিন্তু আজকালকার দিনে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতিতাদৃশী’ কথাটা খাটে না। ভাবনার সঙ্গে খরচও চাই। কিন্তু পণের কথা উঠিলেই অনুকূল বলেন, “আমার তো নিজের মেয়ে আছে, আমি একা আর কত পারিয়া উঠিব।” এমনি করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছিল। এমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন।
তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখ। দোতলার দক্ষিণবারান্দায় চিত্রিত চিক্কণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে শোভমান এবং বরফজলপূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দুজালে মণ্ডিত। মহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে বসিয়াছেন। নীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল দিতেছিল, সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া চৈত্রের দক্ষিণ বাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিল। আশপাশের দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি, ফিসফিস কথা, দুটা-একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়।
আহারের পর অনুকূলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চুনি, পান নিয়ে আয় তো রে।”
কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতের একটা দরজা খুলিয়া গেল এবং একটি বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকূলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।”
বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দার পশ্চিম-প্রান্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল।
বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকূলবাবু কহিলেন, “একটু দাঁড়া চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটো ভাই অপূর্বর কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই।” বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-এক বার চাহিয়া দেখিল।
কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, “এই বারো-তেরো হইবে।” অর্থাৎ চৌদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরু ভাবে তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।” অনুকূলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।” বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশ-পালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা।”
আশা ! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল। অনাথা আশা !
দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ো না।”
বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।”
বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ্য করিতে পারিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা না হয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”
বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন– তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়া যাইত।”
বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহুবিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌঁছিল।
মা তখন লুচিভাজা-ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনো তাঁহার বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই।
মহেন্দ্র একা নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল। কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুজ্ঞের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলসস্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না।”
মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব।”
মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।
তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসংবরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো।”
মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী !”
এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ৎক্ষণ মান-অভিমানের পর মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল।
মেয়ে দেখিবার কথা মহেন্দ্র প্রায় ভুলিয়াছিল, অন্নপূর্ণা ভোলেন নাই। তিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জেঠার বাড়িতে পত্র লিখিয়া দেখিতে যাইবার দিন স্থির করিয়া পাঠাইলেন।
দিন স্থির হইয়াছে শুনিয়াই মহেন্দ্র কহিল, “এত তাড়াতাড়ি কাজটা করিলে কেন কাকী। এখনো বিহারীকে বলাই হয় নাই।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি হয় মহিন। এখন না দেখিতে গেলে তাহারা কী মনে করিবে।”
মহেন্দ্র বিহারীকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল। কহিল, “চলো তো, পছন্দ না হইলে তো তোমার উপর জোর চলিবে না।”
বিহারী কহিল, “সে কথা বলিতে পারি না। কাকীর বোনঝিকে দেখিতে গিয়া পছন্দ হইল না বলা আমার মুখ দিয়া আসিবে না।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো উত্তম কথা।”
বিহারী কহিল, “কিন্তু তোমার পক্ষে অন্যায় কাজ হইয়াছে মহিনদা। নিজেকে হালকা রাখিয়া পরের স্কন্ধে এরূপ ভার চাপানো তোমার উচিত হয় নাই। এখন কাকীর মনে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে বড়োই কঠিন হইবে।”
মহেন্দ্র একটু লজ্জিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল, “তবে কী করিতে চাও।”
বিহারী কহিল, “যখন তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহাকে আশা দিয়াছ, তখন আমি বিবাহ করিব– দেখিতে যাইবার ভড়ং করিবার দরকার নাই।”
অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত।
অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি পছন্দ না হয়, তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল।”
নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও।”
মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি।”
মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে বলিব।”
মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরের জন্য হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ ঢালে।
দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল।
কন্যার জেঠা শ্যামবাজারের অনুকূলবাবু– নিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায় তাঁহার বাগানসমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর তুলিয়াছেন।
দরিদ্র ভ্রাতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পুত্রীকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেন। মাসি অন্নপূর্ণা বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে থাক্।” তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকূল রাজি হইলেন না। এমন-কি, দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া ছিলেন।
কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল কিন্তু আজকালকার দিনে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতিতাদৃশী’ কথাটা খাটে না। ভাবনার সঙ্গে খরচও চাই। কিন্তু পণের কথা উঠিলেই অনুকূল বলেন, “আমার তো নিজের মেয়ে আছে, আমি একা আর কত পারিয়া উঠিব।” এমনি করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছিল। এমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন।
তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখ। দোতলার দক্ষিণবারান্দায় চিত্রিত চিক্কণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে শোভমান এবং বরফজলপূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দুজালে মণ্ডিত। মহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে বসিয়াছেন। নীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল দিতেছিল, সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া চৈত্রের দক্ষিণ বাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিল। আশপাশের দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি, ফিসফিস কথা, দুটা-একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়।
আহারের পর অনুকূলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চুনি, পান নিয়ে আয় তো রে।”
কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতের একটা দরজা খুলিয়া গেল এবং একটি বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকূলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।”
বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দার পশ্চিম-প্রান্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল।
বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকূলবাবু কহিলেন, “একটু দাঁড়া চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটো ভাই অপূর্বর কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই।” বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-এক বার চাহিয়া দেখিল।
কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, “এই বারো-তেরো হইবে।” অর্থাৎ চৌদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরু ভাবে তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।” অনুকূলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।” বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশ-পালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা।”
আশা ! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল। অনাথা আশা !
দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ো না।”
বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।”
বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ্য করিতে পারিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা না হয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”
বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন– তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়া যাইত।”
বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহুবিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌঁছিল।
মা তখন লুচিভাজা-ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনো তাঁহার বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই।
মহেন্দ্র একা নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল। কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুজ্ঞের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলসস্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না।”
মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব।”
মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।
তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসংবরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো।”
মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী !”
এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ৎক্ষণ মান-অভিমানের পর মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল।
Subscribe to:
Comments (Atom)
RSS Feed
Twitter