Wednesday, October 3, 2012


উপন্যাসঃ চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িলদুই জনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন

রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ধরিয়া পড়িলেন, “বাবা মহিন, গরিবের মেয়েটিকে উদ্ধার করিতে হইবেশুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছেতোদের আজকালকার পছন্দর সঙ্গে মিলিবে

মহেন্দ্র কহিল, “মা, আজকালকার ছেলে তো আমি ছাড়াও আরো ঢের আছে

রাজলক্ষ্মীমহিন, ঐ তোর দোষ, তোর কাছে বিয়ের কথাটি পাড়িবার জো নাই

মহেন্দ্রমা , ও কথাটা বাদ দিয়াও সংসারে কথার অভাব হয় নাঅতএব ওটা মারাত্মক দোষ নয়

মহেন্দ্র শৈশবেই পিতৃহীনমা-সম্বন্ধে তাহার ব্যবহার সাধারণ লোকের মতো ছিল নাবয়স প্রায় বাইশ হইল, এম. এ. পাস করিয়া ডাক্তারি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, তবু মাকে লইয়া তাহার প্রতিদিন মান-অভিমান আদর-আবদারের অন্ত ছিল নাকাঙারু-শাবকের মতো মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াও মাতার বহির্গর্ভের থলিটির মধ্যে আবৃত থাকাই তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিলমার সাহায্য ব্যতীত তাহার আহার বিহার আরাম বিরাম কিছুই সম্পন্ন হইবার জো ছিল না

এবারে মা যখন বিনোদিনীর জন্য তাহাকে অত্যন্ত ধরিয়া পড়িলেন, তখন মহেন্দ্র বলিল, “আচ্ছা, কন্যাটি একবার দেখিয়া আসি

দেখিতে যাইবার দিন বলিল, “দেখিয়া আর কী হইবেতোমাকে খুশি করিবার জন্য বিবাহ করিতেছি, ভালোমন্দ বিচার মিথ্যা

কথাটার মধ্যে একটু রাগের উত্তাপ ছিল, কিন্তু মা ভাবিলেন, শুভদৃষ্টির সময় তাঁহার পছন্দর সহিত যখন পুত্রের পছন্দর নিশ্চয় মিল হইবে তখন মহেন্দ্রের কড়ি-সুর কোমল হইয়া আসিবে

রাজলক্ষ্মী নিশ্চিন্তচিত্তে বিবাহের দিন স্থির করিলেনদিন যত নিকটে আসিতে লাগিল, মহেন্দ্রের মন ততই উকণ্ঠিত হইয়া উঠিলঅবশেষে দুই-চার দিন আগে সে বলিয়া বসিল, “না মা, আমি কিছুতেই পারিব না

বাল্যকাল হইতে মহেন্দ্র দেবতা ও মানবের কাছে সর্বপ্রকারে প্রশ্রয় পাইয়াছে, এইজন্য তাহার ইচ্ছার বেগ উচ্ছৃঙ্খলপরের ইচ্ছার চাপ সে সহিতে পারে নাতাহাকে নিজের প্রতিজ্ঞা এবং পরের অনুরোধ একান্ত বাধ্য করিয়া তুলিয়াছে বলিয়াই বিবাহ-প্রস্তাবের প্রতি তাহার অকারণ বিতৃষ্ণা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল এবং আসন্নকালে সে একেবারেই বিমুখ হইয়া বসিল

মহেন্দ্রের পরম বন্ধু ছিল বিহারী; সে মহেন্দ্রকে দাদা এবং মহেন্দ্রের মাকে মা বলিতমা তাহাকে স্টীমবোটের পশ্চাতে আবদ্ধ গাধাবোটের মতো মহেন্দ্রের একটি আবশ্যক ভারবহ আসবাবের স্বরূপ দেখিতেন ও সেই হিসাবে মমতাও করিতেনরাজলক্ষ্মী তাহাকে বলিলেন, “বাবা, এ কাজ তো তোমাকেই করিতে হয়, নহিলে গরিবের মেয়ে– ”

বিহারী জোড়হাত করিয়া কহিল, “মা, ঐটে পারিব নাযে-মেঠাই তোমার মহেন্দ্র ভালো লাগিল না বলিয়া রাখিয়া দেয়, সে-মেঠাই তোমার অনুরোধে পড়িয়া আমি অনেক খাইয়াছি, কিন্তু কন্যার বেলা সেটা সহিবে না

রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘বিহারী আবার বিয়ে করিবে ! ও কেবল মহিনকে লইয়াই আছে, বউ আনিবার কথা মনেও স্থান দেয়
না

এই ভাবিয়া বিহারীর প্রতি তাঁহার কৃপামিশ্রিত মমতা আর-একটুখানি বাড়িল

বিনোদিনীর বাপ বিশেষ ধনী ছিল না, কিন্তু তাহার একমাত্র কন্যাকে সে মিশনারি মেম রাখিয়া বহুযত্নে পড়াশুনা ও কারুকার্য শিখাইয়াছিলকন্যার বিবাহের বয়স ক্রমেই বহিয়া যাইতেছি, তবু তাহার হুঁশ ছিল নাঅবশেষে তাহার মৃত্যুর পরে বিধবা মাতা পাত্র খুঁজিয়া অস্থির হইয়া পড়িয়াছেটাকাকড়িও নাই, কন্যার বয়সও অধিক

তখন রাজলক্ষ্মী তাঁহার জন্মভূমি বারাসতের গ্রামসম্পর্কীয় এক ভ্রাতুষ্পুত্রের সহিত উক্ত কন্যা বিনোদিনীর বিবাহ দেওয়াইলেন

অনতিকাল পরে কন্যা বিধবা হইলমহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাগ্যে বিবাহ করি নাই, স্ত্রী বিধবা হইলে তো এক দণ্ডও টিকিতে পারিতাম না

বছর-তিনেক পরে আর-এক দিন মাতাপুত্রে কথা হইতেছিল

বাবা, লোকে যে আমাকেই নিন্দা করে

কেন মা, লোকের তুমি কী সর্বনাশ করিয়াছ?”

পাছে বউ আসিলে ছেলে পর হইয়া যায়, এই ভয়ে তোর বিবাহ দিতেছি না, লোকে এইরূপ বলাবলি করে

মহেন্দ্র কহিল, “ভয় তো হওয়াই উচিতআমি মা হইলে প্রাণ ধরিয়া ছেলের বিবাহ দিতে পারিতাম নালোকের নিন্দা মাথা পাতিয়া লইতাম

মা হাসিয়া কহিলেন, “শোনো একবার ছেলের কথা শোনো

মহেন্দ্র কহিল, “বউ আসিয়া তো ছেলেকে জুড়িয়া বসেইতখন এত কষ্টের এত স্নেহের মা কোথায় সরিয়া যায়, এ যদি-বা তোমার ভালো লাগে, আমার ভালো লাগে না

রাজলক্ষ্মী মনে মনে পুলকিত হইয়া তাঁহার সদ্যসমাগতা বিধবা জাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “শোনো ভাই মেজোবউ, মহিন কী বলে শোনোবউ পাছে মাকে ছাড়াইয়া উঠে, এই ভয়ে ও বিয়ে করিতে চায় নাএমন সৃষ্টিছাড়া কথা কখনো শুনিয়াছ?”

কাকী কহিলেন, “এ তোমার, বাছা, বাড়াবাড়িযখনকার যা তখন তাই শোভা পায়এখন মার আঁচল ছাড়িয়া বউ লইয়া ঘরকন্না করিবার সময় আসিয়াছে, এখন ছোটো ছেলেটির মতো ব্যবহার দেখিলে লজ্জা বোধ হয়

এ কথা রাজলক্ষ্মীর ঠিক মধুর লাগিল না এবং এই প্রসঙ্গে তিনি যে-কটি কথা বলিলেন, তাহা সরল হইতে পারে, কিন্তু মধুমাখা নহেকহিলেন, “আমার ছেলে যদি অন্যের ছেলেদের চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে, তোমার তাতে লজ্জা করে কেন মেজোবউছেলে থাকিলে ছেলের মর্ম বুঝিতে

রাজলক্ষ্মী মনে করিলেন, পুত্রসৌভাগ্যবতীকে পুত্রহীনা ঈর্ষা করিতেছে

মেজোবউ কহিলেন, “তুমিই বউ আনিবার কথা পাড়িলে বলিয়া কথাটা উঠিল, নহিলে আমার অধিকার কী

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার ছেলে যদি বউ না আনে, তোমার বুকে তাতে শেল বেঁধে কেনবেশ তো, এতদিন যদি ছেলেকে মানুষ করিয়া আসিতে পারি, এখনো উহাকে দেখিতে শুনিতে পারিব, আর কাহারো দরকার হইবে না

মেজোবউ অশ্রুপাত করিয়া নীরবে চলিয়া গেলেনমহেন্দ্র মনে মনে আঘাত পাইল এবং কালেজ হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়াই তাহার কাকীর ঘরে উপস্থিত হইল

কাকী তাহাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহার মধ্যে স্নেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ইহা সে নিশ্চয় জানিতএবং ইহাও তাহার জানা ছিল, কাকীর একটি পিতৃমাতৃহীনা বোনঝি আছে, এবং মহেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া সন্তানহীনা বিধবা কোনো সূত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে কাছে আনিয়া সুখী দেখিতে চানযদিচ বিবাহে সে নারাজ, তবু কাকীর এই মনোগত ইচ্ছাটি তাহার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলিয়া মনে হইত

মহেন্দ্র তাঁহার ঘরে যখন গেল, তখন বেলা আর বড়ো বাকি নাইকাকী অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের কাটা জানালার গরাদের উপর মাথা রাখিয়া শুষ্কবিমর্ষমুখে বসিয়াছিলেনপাশের ঘরে ভাত ঢাকা পড়িয়া আছে, এখনো স্পর্শ করেন নাই

অল্প কারণেই মহেন্দ্রের চোখে জল আসিতকাকীকে দেখিয়া তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিলকাছে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে ডাকিল, “কাকীমা

অন্নপূর্ণা হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “আয় মহিন, বোস

মহেন্দ্র কহিল, “ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে, প্রসাদ খাইতে চাই

অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝিয়া উচ্ছ্বসিত অশ্রু কষ্টে সংবরণ করিলেন এবং নিজে খাইয়া মহেন্দ্রকে খাওয়াইলেন

মহেন্দ্রের হৃদয় তখন করুণায় আর্দ্র ছিলকাকীকে সান্ত্বনা দিবার জন্য আহারান্তে হঠা মনের ঝোঁকে বলিয়া বসিল, “কাকী, তোমার সেই-যে বোনঝির কথা বলিয়াছিলে, তাহাকে একবার দেখাইবে না?”

কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে ভীত হইয়া পড়িল

অন্নপূর্ণা হাসিয়া কহিলেন, “তোর আবার বিবাহে মন গেল নাকি, মহিন

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “না, আমার জন্য নয় কাকী, আমি বিহারীকে রাজি করিয়াছিতুমি দেখিবার দিন ঠিক করিয়া দাও

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “আহা, তাহার কি এমন ভাগ্য হইবেবিহারীর মতো ছেলে কি তাহার কপালে আছে

কাকীর ঘর হইতে বাহির হইয়া মহেন্দ্র দ্বারের কাছে আসিতেই মার সঙ্গে দেখা হইলরাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী মহেন্দ্র, এতক্ষণ তোদের কী পরামর্শ হইতেছিল

মহেন্দ্র কহিল, “পরামর্শ কিছুই না, পান লইতে আসিয়াছি

মা কহিলেন, “তোর পান তো আমার ঘরে সাজা আছে

মহেন্দ্র উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল

রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া অন্নপূর্ণার রোদনস্ফীত চক্ষু দেখিবামাত্র অনেক কথা কল্পনা করিয়া লইলেন

ফোঁস করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “কী গো মেজোঠাকরুন, ছেলের কাছে লাগালাগি করিতেছিলে বুঝি?”

বলিয়া উত্তরমাত্র না শুনিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন 

RE: উপন্যাসঃ চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

মেয়ে দেখিবার কথা মহেন্দ্র প্রায় ভুলিয়াছিল, অন্নপূর্ণা ভোলেন নাইতিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জেঠার বাড়িতে পত্র লিখিয়া দেখিতে যাইবার দিন স্থির করিয়া পাঠাইলেন

দিন স্থির হইয়াছে শুনিয়াই মহেন্দ্র কহিল, “এত তাড়াতাড়ি কাজটা করিলে কেন কাকীএখনো বিহারীকে বলাই হয় নাই

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি হয় মহিনএখন না দেখিতে গেলে তাহারা কী মনে করিবে

মহেন্দ্র বিহারীকে ডাকিয়া সকল কথা বলিলকহিল, “চলো তো, পছন্দ না হইলে তো তোমার উপর জোর চলিবে না

বিহারী কহিল, “সে কথা বলিতে পারি নাকাকীর বোনঝিকে দেখিতে গিয়া পছন্দ হইল না বলা আমার মুখ দিয়া আসিবে না

মহেন্দ্র কহিল, “সে তো উত্তম কথা

বিহারী কহিল, “কিন্তু তোমার পক্ষে অন্যায় কাজ হইয়াছে মহিনদানিজেকে হালকা রাখিয়া পরের স্কন্ধে এরূপ ভার চাপানো তোমার উচিত হয় নাইএখন কাকীর মনে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে বড়োই কঠিন হইবে

মহেন্দ্র একটু লজ্জিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল, “তবে কী করিতে চাও

বিহারী কহিল, “যখন তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহাকে আশা দিয়াছ, তখন আমি বিবাহ করিবদেখিতে যাইবার ভড়ং করিবার দরকার নাই

অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত

অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছানা দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে নাযদি পছন্দ না হয়, তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল

নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও

মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি

মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে বলিব

মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল নাপরের জন্য হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ ঢালে

দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল

কন্যার জেঠা শ্যামবাজারের অনুকূলবাবুনিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায় তাঁহার বাগানসমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর তুলিয়াছেন

দরিদ্র ভ্রাতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পুত্রীকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেনমাসি অন্নপূর্ণা বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে থাক্‌তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকূল রাজি হইলেন নাএমন-কি, দেখাসাক্ষা করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া ছিলেন

কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল কিন্তু আজকালকার দিনে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতিতাদৃশীকথাটা খাটে নাভাবনার সঙ্গে খরচও চাইকিন্তু পণের কথা উঠিলেই অনুকূল বলেন, “আমার তো নিজের মেয়ে আছে, আমি একা আর কত পারিয়া উঠিবএমনি করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছিলএমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন

তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখদোতলার দক্ষিণবারান্দায় চিত্রিত চিক্কণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে শোভমান এবং বরফজলপূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দুজালে মণ্ডিতমহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে বসিয়াছেননীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল দিতেছিল, সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া চৈত্রের দক্ষিণ বাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিলআশপাশের দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি, ফিসফিস কথা, দুটা-একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়

আহারের পর অনুকূলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চুনি, পান নিয়ে আয় তো রে

কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতের একটা দরজা খুলিয়া গেল এবং একটি বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকূলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইলতিনি কহিলেন, “লজ্জা কী মাবাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো

বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিলবারান্দার পশ্চিম-প্রান্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেলসেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল

বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকূলবাবু কহিলেন, “একটু দাঁড়া চুনিবিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটো ভাই অপূর্বর কন্যাসে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাইবলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন

মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিলঅনাথার দিকে আর-এক বার চাহিয়া দেখিল

কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত নাআত্মীয়েরা বলিত, “এই বারো-তেরো হইবেঅর্থা চৌদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিককিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরু ভাবে তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে

আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কীঅনুকূলবাবু উসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলোবালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশ-পালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা

আশা ! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমলঅনাথা আশা !

দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলমহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ো না

বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে

মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না

বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ্য করিতে পারিব

মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়াতোমার বোঝা না হয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লইকী বল

বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিলকহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলোতুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেনতাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন

মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়া যাইত

বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহুবিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌঁছিল

মা তখন লুচিভাজা-ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনো তাঁহার বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই

মহেন্দ্র একা নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইলকলিকাতার হর্ম্যশিখরপুজ্ঞের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিলমা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলসস্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না

মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না?”

মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি

মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি

মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব

মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন

তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসংবরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো

মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী !

এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ক্ষণ মান-অভিমানের পর মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল