Wednesday, October 3, 2012


RE: উপন্যাসঃ চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
১৬
বিহারী ভাবিল, ‘আর দূরে থাকিলে চলিবে না, যেমন করিয়া হউক, ইহাদের মাঝখানে আমাকেও একটা স্থান লইতে হইবেইহাদের কেহই আমাকে চাহিবে না, তবু আমাকে থাকিতে হইবে

বিহারী আহ্বান-অভ্যর্থনার অপেক্ষা না রাখিয়াই মহেন্দ্রের ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিলবিনোদিনীকে কহিল, “বিনোদ-বৌঠান, এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছেতুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নূতন পথ দেখাওদোহাই তোমার

মহেন্দ্রঅর্থা

বিহারীঅর্থা আমার মতো লোক, যাহাকে কেহ কোনোকালে পোঁছে না

মহেন্দ্রতাহাকে মাটি করোমাটি হইবার উমেদারি সহজ নয় হে বিহারী, দরখাস্ত পেশ করিলেই হয় না

বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “মাটি হইবার ক্ষমতা থাকা চাই, বিহারীবাবু

বিহারী কহিল, “নিজগুণ না থাকিলেও হাতের গুণে হইতে পারেএকবার প্রশ্রয় দিয়া দেখোই-না

বিনোদিনীআগে হইতে প্রস্তুত হইয়া আসিলে কিছু হয় না, অসাবধান থাকিতে হয়কী বল, ভাই চোখের বালিতোমার এই দেওরের ভার তুমিই লও-না, ভাই

আশা তাহাকে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঠেলিয়া দিলবিহারীও এ ঠাট্টায় যোগ দিল না

আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো ঠাট্টা সহিবে না, এটুকু বিনোদিনীর কাছে এড়াইতে পারে নাইবিহারী আশাকে শ্রদ্ধা করে এবং বিনোদিনীকে হালকা করিতে চায়, ইহা বিনোদিনীকে বিঁধিল

সে পুনরায় আশাকে কহিল, “তোমার এই ভিক্ষুক দেওরটি আমাকে উপলক্ষ করিয়া তোমারই কাছে আদর ভিক্ষা করিতে আসিয়াছেকিছু দে, ভাই

আশা অত্যন্ত বিরক্ত হইলক্ষণকালের জন্য বিহারীর মুখ লাল হইল, পরক্ষণেই হাসিয়া কহিল, “আমার বেলাতেই কি পরের উপর বরাত চালাইবে, আর মহিনদার সঙ্গেই নগদ কারবার !

বিহারী সমস্ত মাটি করিতে আসিয়াছে, বিনোদিনীর ইহা বুঝিতে বাকি রহিল নাবুঝিল, বিহারীর সম্মুখে সশস্ত্রে থাকিতে হইবে

মহেন্দ্র বিরক্ত হইলখোলসা কথায় কবিত্বের মাধুর্য নষ্ট হয়সে ঈষ তীব্র স্বরেই কহিল, “বিহারী, তোমার মহিনদা কোনো কারবারে যান নাহাতে যা আছে, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট

বিহারীতিনি না যেতে পারেন, কিন্তু ভাগ্যে লেখা থাকিলে কারবারের ঢেউ বাহির হইতে আসিয়াও লাগে

বিনোদিনীআপনার উপস্থিত হাতে কিছুই নাই, কিন্তু আপনার ঢেউটা কোন্‌ দিক হইতে আসিতেছে!বলিয়া সে সকটাক্ষহাস্যে আশাকে টিপিলআশা বিরক্ত হইয়া উঠিয়া গেলবিহারী পরাভূত হইয়া ক্রোধে নীরব হইল; উঠিবার উপক্রম করিতেই বিনোদিনী কহিল, “হতাশ হইয়া যাবেন না, বিহারীবাবুআমি চোখের বালিকে পাঠাইয়া দিতেছি

বিনোদিনী চলিয়া যাইতেই সভাভঙ্গে মহেন্দ্র মনে মনে রাগিলমহেন্দ্রের অপ্রসন্ন মুখ দেখিয়া বিহারীর রুদ্ধ আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলকহিল, “মহিনদা, নিজের সর্বনাশ করিতে চাও, করোবরাবর তোমার সেই অভ্যাস হইয়া আসিয়াছেকিন্তু যে সরলহৃদয়া সাধ্বী তোমাকে একান্ত বিশ্বাসে আশ্রয় করিয়া আছে, তাহার সর্বনাশ করিয়ো নাএখনো বলিতেছি, তাহার সর্বনাশ করিয়ো না

বলিতে বলিতে বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল

মহেন্দ্র রুদ্ধরোষে কহিল, “বিহারী, তোমার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি নাহেঁয়ালি ছাড়িয়া স্পষ্ট কথা কও

বিহারী কহিল, “স্পষ্টই কহিববিনোদিনী তোমাকে ইচ্ছা করিয়া অধর্মের দিকে টানিতেছে এবং তুমি না জানিয়া মূঢ়ের মতো অপথে পা বাড়াইতেছ

মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিয়া কহিল, “মিথ্যা কথাতুমি যদি ভদ্রলোকের মেয়েকে এমন অন্যায় সন্দেহের চোখে দেখ, তবে অন্তঃপুরে তোমার আসা উচিত নয়

এমন সময় একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজাইয়া বিনোদিনী হাস্যমুখে তাহা বিহারীর সম্মুখে রাখিলবিহারী কহিল, “এ কী ব্যাপারআমার তো ক্ষুধা নাই

বিনোদিনী কহিল, “সে কি হয়একটু মিষ্টমুখ করিয়া আপনাকে যাইতেই হইবে

বিহারী হাসিয়া কহিল, “আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইল বুঝিসমাদর আরম্ভ হইল

বিনোদিনী অত্যন্ত টিপিয়া হাসিল; কহিল, “আপনি যখন দেওর তখন সম্পর্কের যে জোর আছেযেখানে দাবি করা চলে
সেখানে ভিক্ষা করা কেনআদর যে কাড়িয়া লইতে পারেনকী বলেন মহেন্দ্রবাবু

মহেন্দ্রবাবুর তখন বাক্যস্ফূর্তি হইতেছিল না

বিনোদিনীবিহারীবাবু, লজ্জা করিয়া খাইতেছেন না, না রাগ করিয়া? আর-কাহাকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে?

বিহারীকোনো দরকার নাইযাহা পাইলাম তাহাই প্রচুর

বিনোদিনীঠাট্টা? আপনার সঙ্গে পারিবার জো নাইমিষ্টান্ন দিলেও মুখ বন্ধ হয় না

রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্রকাশ করিলমহেন্দ্র অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল নাসম্পূর্ণ যোগ দিল

প্রাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়ি গেলকহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়

বিহারী কহিল, “তাই নাকিতবে কাজটা ভালো হয় নাতিনি যদি আপত্তি করেন, তাঁর সামনে নাই
গেলাম

মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইলএত সহজে এই অপ্রিয় কার্য শেষ হইবে, তাহা সে মনে করে নাইবিহারীকে মহেন্দ্র ভয় করে

সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বৌঠান, মাপ করিতে হইবে

বিনোদিনীকেন, বিহারীবাবু

বিহারীমহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেনতাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব

বিনোদিনীসে কি হয়, বিহারীবাবুআমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্যে কেন যাইবেনএত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না

এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ ম্লান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেল

বিহারী ক্ষণকালের জন্যে মনে করিল, ‘মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি যাইবে বলিয়া ধরিয়া বসিয়াছে

মহেন্দ্র কহিল, “কেন মা, এখানে তাঁর কি অসুবিধা হইতেছে

রাজলক্ষ্মীঅসুবিধা নাবউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থবয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশি দিন থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে

মহেন্দ্র ক্ষুদ্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল?”

বিহারী বসিয়া ছিলমহেন্দ্র তাহার প্রতি ভর্সনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল

অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, ‘কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল; বিনোদিনী বোধ হয় তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে

স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল

ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই !উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!

বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই

মহেন্দ্র কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা

আশা কহিল, “তবে কেন এমন করিয়া আমাদের মন কাড়িয়া লইলে

সেদিন কিছুই স্থির হইল নাবিনোদিনী কহিল, “না ভাই, কাজ নাই, দুদিনের জন্য মায়া না বাড়ানোই ভালোবলিয়া ব্যাকুলচক্ষে একবার মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল

পরদিন বিহারী আসিয়া কহিল, “বিনোদ-বৌঠান, যাবার কথা কেন বলিতেছেনকিছু দোষ করিয়াছি কিতাহারই শাস্তি?”

বিনোদিনী একটু মুখ ফিরাইয়া কহিল, “দোষ আপনি কেন করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ

বিহারীআপনি যদি চলিয়া যান তো আমার কেবলই মনে হইবে, আমারই উপর রাগ করিয়া গেলেন

বিনোদিনী করুণচক্ষে মিনতি প্রকাশ করিয়া বিহারীর মুখের দিকে চাহিলকহিল, “আমার কি থাকা উচিত হয়, আপনিই বলুন-না

বিহারী মুশকিলে পড়িলথাকা উচিত, এ কথা সে কেমন করিয়া বলিবেকহিল, “অবশ্য আপনাকে তো যাইতেই হইবে, নাহয় আর দু-চার দিন থাকিয়া গেলেন, তাহাতে ক্ষতি কী

বিনোদিনী দুই চক্ষু নত করিয়া কহিল, “আপনারা সকলেই আমাকে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেনআপনাদের কথা এড়াইয়া যাওয়া আমার পক্ষে কঠিনকিন্তু আপনারা বড়ো অন্যায় করিতেছেন

বলিতে বলিতে তাহার ঘনদীর্ঘ চক্ষুপল্লবের মধ্য দিয়া মোটা মোটা অশ্রুর ফোঁটা দ্রুতবেগে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল

বিহারী এই নীরব অজস্র অশ্রুজলে ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “কয়দিনমাত্র আসিয়া আপনার গুণে আপনি সকলকে বশ করিয়া লইয়াছেন, সেইজন্যই আপনাকে কেহ ছাড়িতে চান নাকিছু মনে করিবেন না বিনোদ-বৌঠান, এমন লক্ষ্মীকে কে ইচ্ছা করিয়া বিদায় দেয় !

আশা এক কোণে ঘোমটা দিয়া বসিয়া ছিল, সে আঁচল তুলিয়া ঘনঘন চোখ মুছিতে লাগিলইহার পরে বিনোদিনী আর যাইবার কথা উত্থাপন করিল না 

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks