Wednesday, October 3, 2012


তৃতীয় পরিচ্ছেদ : বিজনে
“ – Like a veil
Which if withdrawn, would but disclose the frown
Of one who hates us, so the night was shown
And grimly darked o’er their faces pale
And hopeless eyes.”
Don Juan
যে স্থানে নবকুমারকে ত্যাগ করিয়া যাত্রীরা চলিয়া যান, তাহার অনতিদূরে দৌলতপুর ও দরিয়াপুর নামে দুই ক্ষুদ্র গ্রাম এক্ষণে দৃষ্ট হয়পরন্তু যে সময়ের বর্ণনায় আমরা প্রবৃত্ত হইয়াছি, সে সময়ে তথায় মনুষ্যবসতির কোন চিহ্ন ছিল নাঅরণ্যময় মাত্রকিন্তু বাঙলাদেশের অন্যত্র ভূমি যেরূপ সচরাচর অনুদঘাতিনী, এ প্রদেশে সেরূপ নহেরসুলপুরের মুখ হইতে সুবর্ণরেখা পর্য্যন্ত অবাধে কয়েক যোজন পথ ব্যাপিত করিয়া এক বালুকাস্তূপশ্রেণী বিরাজিত আছেআর কিছু উচ্চ হইলে ঐ বালুকাস্তূপশ্রেণীকে বালুকাময় ক্ষুদ্র পর্ব্বতশ্রেণী বলা যাইতে পারিতএক্ষণে লোকে উহাকে বালিয়াড়ি বলেঐ সকল বালিয়াড়ির ধবল শিখরমালা মধ্যাহ্নসূর্য্যকিরণে দূর হইতে অপূর্ব্ব প্রভাবিশিষ্ট দেখায়উহার উপর উচ্চ বৃক্ষ জন্মে নাস্তূপতলে সামান্য ক্ষুদ্র বন জন্মিয়া থাকে, কিন্তু মধ্যদেশে বা শিরোভাগে প্রায়ই ছায়াশূন্য ধবলশোভা বিরাজ করিতে থাকেঅধোভাগমণ্ডনকারী বৃক্ষাদির মধ্যে ঝাটী, বনঝাউ এবং বনপুষ্পই অধিক
এইরূপ অপ্রফুল্লকর স্থানে নবকুমার সঙ্গিগণকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছিলেনতিনি প্রথমে কাষ্ঠভার লইয়া, নদীতীরে আসিয়া নৌকা দেখিলেন না; তখন তাঁহার অকস্মা অত্যন্ত ভয়সঞ্চার হইল বটে, কিন্তু সঙ্গিগণ যে তাঁহাকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে, এমত বোধ হইল নাবিবেচনা করিলেন, জলোচ্ছ্বাসে সৈকতভূমি প্লাবিত হওয়ায়, তাঁহারা নিকটস্থ অন্য কোন স্থানে নৌকা রক্ষা করিয়াছেন, শীঘ্র তাঁহাকে সন্ধান করিয়া লইবেনএই প্রত্যাশায় কিয়ক্ষণ তথায় বসিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন; কিন্তু নৌকা আইল নানৌকারোহীও কেহ দেখা দিল নানবকুমার ক্ষুধায় অত্যন্ত পীড়িত হইলেনআর প্রতীক্ষা করিতে না পারিয়া, নৌকার সন্ধানে নদীর তারে তীরে ফিরিতে লাগিলেনকোথাও নৌকার সন্ধান পাইলেন না; প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া পূর্ব্বস্থানে আসিলেনতখন পর্য্যন্ত নৌকা না দেখিয়া বিবেচনা করিলেন, জোয়ারের বেগে নৌকা ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে, এখন প্রতিকূল স্রোতে প্রত্যাগমন করিতে সঙ্গীদিগের কাজেকাজেই বিলম্ব হইতেছেকিন্তু জোয়ারও শেষ হইলতখন ভাবিলেন, প্রতিকূল স্রোতের বেগাধিক্যবশতঃ জোয়ারে নৌকা ফিরিয়া আসিতে পারে নাই; এক্ষণে ভাঁটায় অবশ্য ফিরিয়া আসিতেছেকিন্তু ভাঁটাও ক্রমে অধিক হইল ক্রমে ক্রমে বেলাবসান  হইয়া আসিল; সূর্য্যাস্ত হইলযদি নৌকৈা ফিরিয়া আসিবার হইত, তবে এতক্ষণ ফিরিয়া আসিত
তখন নবকুমারের প্রতীতি হইল যে, হয় জলোচ্ছ্বাসসম্ভূত তরঙ্গে নৌকা জলমগ্ন হইয়াছে, নচে সঙ্গিগণ তাঁহাকে এই বিজনে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে
নবকুমার দেখিলেন যে, গ্রাম নাই, আশ্রয় নাই, লোক নাই, আহার্য্য নাই, পেয় নাই, নদীর জল অসহ্য লবণাত্মক; অথচ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছিলদুরন্ত শীতনিবারণজন্য আশ্রয় নাই, গাত্রবস্ত্র পর্য্যন্ত নাইএই তুষার-শীতল-বায়ু-সঞ্চারিত-নদীতীরে, হিমবর্ষী আকাশতলে, নিরাশ্রয়ে নিরাবরণে শয়ন করিয়া থাকিতে হইবেকরাত্রিমধ্যে ব্যাঘ্র ভল্লুকের সাক্ষা পাইবার সম্ভাবনাপ্রাণনাশই নিশ্চিত
মনের চাঞ্চল্যহেতু নবকুমার একস্থানে অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিলেন নাতীর ত্যাগ করিয়া উপরে উঠিলেনইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলেনক্রমে অন্ধকার হইলশিশিরাকাশে নক্ষত্রমণ্ডলী নীরবে ফুটিতে লাগিল, যেমন নবকুমারের স্বদেশে ফুটিতে থাকে, তেমনি ফুটিতে লাগিলঅন্ধকারে সর্ব্বত্র জনহীন, – আকাশ, প্রান্তর, সমুদ্র, সর্ব্বত্র নীরব, কেবল অবিরল কল্লোলিত সমুদ্রগর্জ্জন আর কদাচি বন্য পশুর রবতথাপি নবকুমারে সেই অন্ধকারে হিমবর্ষী আকাশতলে বালুকাস্তূপের চতুঃপার্শ্বে ভ্রমণ করিতে লাগিলেনচলিতে চলিতে প্রতি পদে হিংস্র পশু কর্ত্তৃক  আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনাকিন্তু একস্থানে বসিয়া থাকিলেও সেই আশঙ্কা
ভ্রমণ করিতে করিতে নবকুমারের শ্রম জন্মিলসমস্ত দিন অনাহার, এজন্য অধিক অবসন্ন হইলেনএক স্থানে বালিয়াড়ির পার্শ্বে পৃষ্ঠরক্ষা করিয়া বসিলেনগৃহের সুখতপ্ত শয্যা মনে পড়িলযখন শারীরিক ও মানসিক ক্লেশের অবসাদে চিন্তা উপস্থিত হয়, তখন কখনও কখনও নিদ্রা আসিয়া সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হয়নবকুমার চিন্তা করিতে করিতে তন্দ্রাভিভূত হইলেনবোধ হয় যদি এরূপ নিয়ম না থাকিত, তবে সাংসারিক ক্লেশের অপ্রতিহত বেগ সকলে সকল সময় সহ্য করিতে পারিত না

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks