Wednesday, October 3, 2012


RE: উপন্যাসঃ চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
১১
আশার পক্ষে সঙ্গিনীর বড়ো দরকার হইয়াছিলভালোবাসার উসবও কেবলমাত্র দুটি লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় নাসুখালাপের মিষ্টান্ন বিতরণের জন্য বাজে লোকের দরকার হয়

ক্ষুধিতহৃদয়া বিনোদিনীও নববধূর নবপ্রেমের ইতিহাস মাতালের জ্বালাময় মদের মতো কান পাতিয়া পান করিতে লাগিলতাহার মস্তিষ্ক মাতিয়া শরীরের রক্ত জ্বলিয়া উঠিল

নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে মা যখন ঘুমাইতেছেন, দাসদাসীরা একতলার বিশ্রামশালায় অদৃশ্য, মহেন্দ্র বিহারীর তাড়নায় ক্ষণকালের জন্য কালেজে গেছে এবং রৌদ্রতপ্ত নীলিমার শেষ প্রান্ত হইতে চিলের তীব্র কণ্ঠ অতিক্ষীণ স্বরে কদাচি শুনা যাইতেছে, তখন নির্জন শয়নগৃহে নীচের বিছানায় বালিশের উপর আশা তাহার খোলা চুল ছড়াইয়া শুইত এবং বিনোদিনী বুকের নীচে বালিশ টানিয়া উপুড় হইয়া শুইয়া গুনগুন-গুঞ্জরিত কাহিনীর মধ্যে আবিষ্ট হইয়া রহিত, তাহার কর্ণমূল আরক্ত হইয়া উঠিত, নিশ্বাস বেগে প্রবাহিত হইতে থাকিত

বিনোদিনী প্রশ্ন করিয়া করিয়া তুচ্ছতম কথাটি পর্যন্ত বাহির করিত, এক কথা বার বার করিয়া শুনিত, ঘটনা নিঃশেষ হইয়া গেলে কল্পনার অবতারণা করিতকহিত, “আচ্ছা ভাই, যদি এমন হইত তো কী হইত, যদি অমন হইত তো কী করিতেসেই-সকল অসম্ভাবিত কল্পনার পথে সুখালোচনাকে সুদীর্ঘ করিয়া টানিয়া লইয়া চলিতে আশারও ভালো লাগিত

বিনোদিনী কহিত, “আচ্ছা ভাই চোখের বালি, তোর সঙ্গে যদি বিহারীবাবুর বিবাহ হইত

আশানা ভাই, ও কথা তুমি বলিয়ো নাছি ছি, আমার বড়ো লজ্জা করেকিন্তু তোমার সঙ্গে হইলে বেশ হইত, তোমার সঙ্গেও তো কথা হইয়াছিল

বিনোদিনীআমার সঙ্গে তো ঢের লোকের ঢের কথা হইয়াছিলনা হইয়াছে, বেশ হইয়াছেআমি যা আছি, বেশ আছি

আশা তাহার প্রতিবাদ করেবিনোদিনীর অবস্থা যে তাহার অবস্থার চেয়ে ভালো, এ কথা সে কেমন করিয়া স্বীকার করিবেএকবার মনে করিয়া দেখো দেখি ভাই বালি, যদি আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার বিবাহ হইয়া যাইতআর একটু হলেই তো হইত

তা তো হইতইনা হইল কেনআশার এই বিছানা, এই খাট তো একদিন তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া ছিলবিনোদিনী এই সুসজ্জিত শয়নঘরের দিকে চায়, আর সে কথা কিছুতেই ভুলিতে পারে নাএ ঘরে আজ সে অতিথিমাত্রআজ স্থান পাইয়াছে, কাল আবার উঠিয়া যাইতে হইবে

অপরাহ্নে বিনোদিনী নিজে উদ্‌‍যোগী হইয়া অপরূপ নৈপুণ্যের সহিত আশার চুল বাঁধিয়া সাজাইয়া তাহাকে স্বামিসম্মিলনে পাঠাইয়া দিততাহার কল্পনা যেন অবগুণ্ঠিতা হইয়া এই সজ্জিতা বধূর পশ্চা পশ্চা মুগ্ধ যুবকের অভিসারে জনহীন কক্ষে গমন করিতআবার এক-এক দিন কিছুতেই আশাকে ছাড়িয়া দিত নাবলিত, “আঃ, আর-একটু বসোই-নাতোমার স্বামী তো পালাইতেছেন নাতিনি তো বনের মায়ামৃগ নন, তিনি অঞ্চলের পোষা হরিণএই বলিয়া নানা ছলে ধরিয়া রাখিয়া দেরি করাইবার চেষ্টা করিত

মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগ করিয়া বলিত, “তোমার সখী যে নড়িবার নাম করেন নাতিনি বাড়ি ফিরিবেন কবে

আশা ব্যগ্র হইয়া বলিত, “না, তুমি আমার চোখের বালির উপর রাগ করিয়ো নাতুমি জান না, সে তোমার কথা শুনিতে কত ভালোবাসেকত যত্ন করিয়া সাজাইয়া আমাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দেয়

রাজলক্ষ্মী আশাকে কাজ করিতে দিতেন নাবিনোদিনী বধূর পক্ষ লইয়া তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত করাইলপ্রায় সমস্ত দিনই বিনোদিনীর কাজে আলস্য নাই, সেই সঙ্গে আশাকেও সে আর ছুটি দিতে চায় নাবিনোদিনী পরে-পরে এমনি কাজের শৃঙ্খল বানাইতেছিল যে, তাহার মধ্যে ফাঁক পাওয়া আশার পক্ষে ভারি কঠিন হইয়া উঠিলআশার স্বামী ছাদের উপরকার শূন্য ঘরের কোণে বসিয়া আক্রোশে ছটফট করিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া বিনোদিনী মনে মনে তীব্র কঠিন হাসি হাসিতআশা উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিত, “এবার যাই ভাই চোখের বালি, তিনি আবার রাগ করিবেন

বিনোদিনী তাড়াতাড়ি বলিত, “রোসো, এইটুকু শেষ করিয়া যাওআর বেশি দেরি হইবে না

খানিক বাদে আশা আবার ছটফট করিয়া বলিয়া উঠিত, “না ভাই, এবার তিনি সত্যসত্যই রাগ করিবেন-আমাকে ছাড়ো, আমি যাই

বিনোদিনী বলিত, “আহা, একটু রাগ করিলই বাসোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকে নাতরকারিতে লঙ্কামরিচের মতো

কিন্তু লঙ্কামরিচের স্বাদটা যে কী, তাহা বিনোদিনীই বুঝিতেছিলকেবল সঙ্গে তাহার তরকারি ছিল নাতাহার শিরায় শিরায় যেন আগুন ধরিয়া গেলসে যে দিকে চায়, তাহার চোখে যেন স্ফুলিঙ্গবর্ষণ হইতে থাকেএমন সুখের ঘরকন্নাএমন সোহাগের স্বামীএ ঘরকে যে আমি রাজার রাজত্ব, এ স্বামীকে যে আমি পায়ের দাস করিয়া রাখিতে পারিতামতখন কি এ ঘরের এই দশা, এ মানুষের এই ছিরি থাকিতআমার জায়গায় কিনা এই কচি খুকি, এই খেলার পুতুল !’ (আশার গলা জড়াইয়া) ভাই চোখের বালি, বলো-না ভাই, কাল তোমাদের কী কথা হইল ভাইআমি তোমাকে যাহা শিখাইয়া দিয়াছিলাম তাহা বলিয়াছিলে? তোমাদের ভালোবাসার কথা শুনিলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না ভাই।" 

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks