Wednesday, October 3, 2012


সপ্তম পরিচ্ছেদ : অন্বেষণে
“And the great lord of Luna
Fell at that deadly stroke
As falls on
mount Alvernus
A thunder-smitten oak.”
Lays of Ancient Rome
এদিকে কাপালিক গৃহমধ্যে তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়া, না খড়্গ, না কপালকুণ্ডলাকে দেখিতে পাইয়া সন্দিগ্ধচিত্তে সৈকতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলতথায় আসিয়া দেখিল যে, নবকুমার তথায় নাইইহাতে অত্যন্ত বিস্ময় জন্মিলকিয়ক্ষণ পরেই ছিন্ন লতাবন্ধনের উপর দৃষ্টি পড়িলতখন স্বরূপ অনুভূত করিতে পারিয়া কাপালিক নবকুমারের অন্বেষণে ধাবিত হইলকিন্তু বিজনমধ্যে পলাতকেরা কোন দিকে কোন পথে গিয়াছে তাহা স্থির করা দুঃসাধ্যঅন্ধকারবশতঃ কাহাকেও দৃষ্টিপথবর্ত্তী করিতে পারিল নাএজন্য বাক্যশব্দ লক্ষ্য করিয়া ক্ষণেক ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলকিন্তু সকল সময়ে কণ্ঠধ্বনিও শুনিতে পাওয়া গেল নাঅতএব বিশেষ করিয়া চারিদিক পর্য্যবেক্ষণ করিবার অভিপ্রায়ে এক উচ্চ বালিয়াড়ির শিখরে উঠিলকাপালিক এক পার্শ্ব দিয়া উঠিল; তাহার অন্যতর পার্শ্বে বর্ষার জলপ্রবাহে স্তূপমূল ক্ষয়িত হইয়াছিলতাহা সে জানিত নাশিখরে আরোহণ করিবামাত্র কাপালিকের শরীরভারে সেই পতনোন্মুখ স্তূপশিখর ভগ্ন হইয়া অতি ঘোর রবে ভূপতিত হইলপতনকালে পর্ব্বতশিখরচ্যুত মহিষের ন্যায় কাপালিকও তসঙ্গে পড়িয়া গেল
অষ্টম পরিচ্ছেদ : আশ্রয়ে
“And that very night –
Shall Romeo bear thee to
Mantua.”
Romeo and Juliet
সেই অমাবস্যার ঘোরান্ধকার যামিনীতে দুই জনে ঊর্ধ্বশ্বাসে বনমধ্যে প্রবেশ করিলেনবন্য পথ নবকুমারের অপরিজ্ঞাত; কেবল সহচরিণী ষোড়শীকে লক্ষ্য করিয়া তদ্বর্ত্মসম্বর্ত্তী বওয়া ব্যতীত তাঁহার অন্য উপায় নাইমনে মনে ভাবিলেন, “এও কপালে ছিল!নবকুমার জানিতেন না যে, বাঙ্গালী অবস্থার বশীভূত, অবস্থা বাঙ্গালীর বশীভূত হয় নাজানিলে এ দুঃখ করিতেন নাক্রমে তাঁহারা পাদবিক্ষেপ মন্দ করিয়া চলিতে লাগিলেনঅন্ধকারে কিছুই লক্ষ্য হয় না; কেবল কখন কোথাও নক্ষত্রালোকে কোন বালুকাস্তূপের শুভ্র শিখর অস্পষ্ট দেখা যায় কোথাও খদ্যোতমালাসংবৃত বৃক্ষের অবয়ব জ্ঞানগোচর হয়
কপালকুণ্ডলা পথিককে সমভিব্যাহারে লইয়া, নিভৃত কাননাভ্যন্তরে উপনীত হইলেনতখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরসম্মুখে অন্ধকারে বনমধ্যে এক অত্যুচ্চ দোবালয়চূড়া লক্ষিত হইল; তন্নিকটে ইষ্টকনির্ম্মিত প্রাচীরবেষ্টিত একটী গৃহও দেখা গেলকপালকুণ্ডলা প্রাচীরদ্বারের নিকটস্থ হইয়া তাহাতে কারাঘাত করিতে লাগিলেন; পুনঃ পুনঃ করাঘাত করাতে ভিতর হইতে এক ব্যক্তি কহিল, “কে ও, কপালকুণ্ডলা বুঝি?” কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “দ্বার খোল
উত্তরকারী আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিলযে ব্যক্তি দ্বার খুলিয়া দিল, সে ঐ দেবালয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতার সেবক বা অধিকারী; বয়সে পঞ্চাশসর অতিক্রম করিয়াছিলকপালকুণ্ডলা তাঁহার বিরলকেশ মস্তক কর দ্বারা আকর্ষিত করিয়া আপন অধরের নিকট তাঁহারা শ্রবণেন্দ্রিয় আনিলেন এবং দুই চারি কথায় নিজ সঙ্গীর অবস্থা বুঝাইয়া দিলেনঅধিকারী বহুক্ষণ পর্য্যন্ত করতললগ্নশীর্ষ হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেনপরিশেষে কহিলেন, “এ বড় বিষম ব্যাপারমহাপুরুষ মনে করিলে সকল করিতে পারেনযাহা হউক, মায়ের প্রসাদে তোমার অমঙ্গল ঘটিবে নাসে ব্যক্তি কোথায়?”
কপালকুণ্ডলা আইসবলিয়া নবকুমারকে আহ্বান করিলেননবকুমার অন্তরালে দাঁড়াইয়াছিলেন, আহূত হইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেনঅধিকারী তাঁহাকে কহিলেন, “আজি এইখানে লুকাইয়া থাক, কালি প্রত্যূষে তোমাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব
ক্রমে কথায় কথায় অধিকারী জানিতে পারিলেন যে, এ পর্য্যন্ত নবকুমারের আহারাদি হয় নাইইহাতে অধিকারী তাঁহার আহারের আয়োজন করিতে প্রবৃত্ত হইলে, নবকুমার আহারে নিতান্ত অস্বীকৃত হইয়া কেবলমাত্র বিশ্রামস্থানের প্রার্থনা জানাইলেনঅধিকারী নিজ রন্ধনশালায় নবকুমারের শয্যা প্রস্তুত করিয়া দিলেননবকুমার শয়ন করিলে, কপালকুণ্ডালা সমুদ্রতীরে প্রত্যাগমন করিবার উদ্যোগ করিলেনঅধিকারী তাঁহার প্রতি সস্নেহ নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “যাইও নাক্ষণেক দাঁড়াও, এক ভিক্ষা আছে
কপালকুণ্ডলা কি?
অধিকারী তোমাকে দেখিয়া পর্য্যন্ত মা বলিয়া থাকি, দেবীর পাদস্পর্শ করিয়া শপথ করিতে পারি যে, মাতার অধিক তোমাকে স্নেহ করিআমার ভিক্ষা অবহেলা করিবে না?
কপা করিব না
অধি আমার এই ভিক্ষা, তুমি আর সেখানে ফিরিয়া যাইও না
কপা কেন?
অধি গেলে তোমার রক্ষা নাই
কপা তা ত জানি
অধি তবে আর জিজ্ঞাসা কর কেন?
কপা না গিয়া কোথায় যাইব?
অধি এই পথিকের সঙ্গে দেশান্তরে যাও
কপালকুণ্ডলা নীরব হইয়া রহিলেনঅধিকারী কহিলেন, “মা, কি ভাবিতেছ?”
কপা যখন তোমার শিষ্য আসিয়াছিল, তখন তুমি কহিয়াছিলে যে, যুবতীর এরূপ যুবাপুরুষের সহিত যাওয়া অনুচিত; এখন যাইতে বল কেন?
অধি তখন তোমার জীবনের আশঙ্কা করি নাই, বিশেষ যে সদুপায়ের সম্ভাবনা ছিল না, এখন সে সদুপায় হইতে পারিবেআইস, মায়ের অনুমতি লইয়া আসি
এই বলিয়া অধিকারী দীপহস্তে দেবালয়ের দ্বারে গিয়া দ্বারোদ্ঘাটন করিলেনকপালকুণ্ডলাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গেলেনমন্দিরমধ্যে মানবাকারপরিমিতা করাল কালীমূর্ত্তি সংস্থাপিত ছিলউভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেনঅধিকারী আচমন করিয়া পুষ্পপাত্র হইতে অচ্ছিন্ন বিল্বপত্র লইয়া মন্ত্রপূত করিলেন এবং তাহা প্রতিমার পাদোপরি সংস্থাপিত করিয়া তপ্রতি চাহিয়া রহিলেনক্ষণেক পরে অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন,
মা, দেখ দেবী অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছেন; বিল্বপত্র পড়ে নাইযে মানস করিয়া অর্ঘ্য দিয়াছিলাম, তাহাতে অবশ্য মঙ্গলতুমি এই পথিকের সঙ্গে সচ্ছন্দে গমন কর; কিন্তু আমি বিষয়ী লোকের রীতি চরিত্র জানিতুমি যদি গলগ্রহ হইয়া যাও, তবে এ ব্যক্তি অপরিচিত যুবতী সঙ্গে লইয়া লোকালয়ে লজ্জা পাইবেতোমাকেও লোকে ঘৃণা করিবেতুমি বলিতেছ এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণসন্তান; গলাতেও যজ্ঞোপবীত দেখিতেছিএ যদি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইয়া যায়, তবে সকল মঙ্গলনচে আমিও তোমাকে ইহার সহিত যাইতে বলিতে পারি না
বিবা”! এই কথাটি কপালকুণ্ডলা অতি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করিলেনবলিতে লাগিলেন, “বিবাহের নাম ত তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি, কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানি নাকি করিতে হইবে?”
অধিকারী ঈষন্মাত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “বিবাহ স্ত্রীলোকের একমাত্র ধর্ম্মের সোপান; এই জন্য স্ত্রীকে সহধর্ম্মিণী বলে; জগন্মাতাও শিবের বিবাহিতা
অধিকারী মনে করিলেন সকলই বুঝাইলেনকপালকুণ্ডলা মনে করিলেন, সকলই বুঝিলেনবলিলেন,
তাহা হউককিন্তু তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে আমার মন সরিতেছে নাতিনি যে এতদিন আমাকে প্রতিপালন করিয়াছেন
অধি কি জন্য প্রতিপালন করিয়াছেন, তাহা জান না
এই বলিয়া অধিকারী তান্ত্রিক সাধনে স্ত্রীলোকের যে সম্বন্ধ, তাহা অস্পষ্ট রকম কপালকুণ্ডলাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেনকপালকুণ্ডলা তাহা কিছু বুঝিল না, কিন্তু তাহার বড় ভয় হইলবলিল, “তবে বিবাহই হউক
এই বলিয়া উভয়ে মন্দির হইতে বহির্গত হইলেনএক কক্ষমধ্যে কপালকুণ্ডলাকে বসাইয়া, অধিকারী নবকুমারের শয্যাসান্নিধ্যে গিয়া তাঁহার শিয়রে বসিলেনজিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! নিদ্রিত কি?”
নবকুমারের নিদ্রা যাইবার অবস্থা নহে; নিজ দশা ভাবিতেছিলেনবলিলেন, “আজ্ঞা না
অধিকারী কহিলেন, “মহাশয়! পরিচয়টা লইতে একবার আসিলাম, আপনি ব্রাহ্মণ?”
অধি কোন্‌ শ্রেণী
নব রাঢ়ীয় শ্রেণী
অধি আমরাও রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কল ব্রাহ্মণ বিবেচনা করিবেন নাবংশে কুলাচার্য্য, তবে এক্ষণে মায়ের পদাশ্রয়ে আছিমহাশয়ের নাম?
নব নবকুমার শর্ম্মা
অধি নিবাস?
নব সপ্তগ্রাম
অধি আপনারা কোন্‌ গাঁই?
নব বন্দ্যঘটী
অধি কয় সংসার করিয়াছেন
নব এক সংসার মাত্র
নবকুমার সকল কথা খুলিয়া বলিলেন নাপ্রকৃতপক্ষে তাঁহার এক সংসারও ছিল নাতিনি রামগোবিন্দ ঘোষালের কন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেনবিবাহের পর পদ্মাবতী কিছু দিন পিত্রালয়ে রহিলেনমধ্যে মধ্যে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করিতেনযখন তাঁহার বয়স ত্রয়োদশ বসর, তখন তাঁহার পিতা সপরিবারে পুরুষোত্তম দর্শনে গিয়াছিলেনএই সময়ে পাঠানেরা আকবর শাহ কর্ত্তৃক বঙ্গদেশ হইতে দূরীভূত হইয়া উড়িষ্যায় সদলে বসতি করিতেছিলতাহাদিগের দমনের জন্য আকবর শাহ বিধিমতে যত্ন পাইতে লাগিলেনযখন রামগোবিন্দ ঘোষাল উড়িষ্যা হইতে প্রত্যাগমন করেন, তখন মোগল পাঠানের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছেআগমনকালে তিনি  পথিমধ্যে পাঠানসেনার হস্তে পতিত হয়েনপাঠানেরা তকালে ভদ্রভদ্র বিচারশূন্য; তাহার নিরপরাধী পথিকের প্রতি অর্থের জন্য বলপ্রকাশের চেষ্টা করিতে লাগিলরামগোবিন্দ কিছু উগ্রস্বভাব; পাঠানদিগকে কটু কহিতে লাগিলেনইহার ফল এই হইল যে, সপরিবারে অবরুদ্ধ হইলেন; পরিশেষে জাতীয় ধর্ম্ম বিসর্জ্জনপূর্ব্বক সপরিবারে মুসলমান হইয়া নিষ্কৃতি পাইলেন
রামগোবিন্দ ঘোষাল সপরিবারে প্রাণ লইয়া বাটী আসিলেন বটে, কিন্তু মুসলমান বলিয়া আত্মীয় জনসমাজে এককালীন পরিত্যক্ত হইলেনএ সময়ে নবকুমারের পিতা বর্তমান ছিলেন, তাঁহাকে সুতরাং জাতিভ্রষ্ট বৈবাহিকের সহিত জাতিভ্রষ্টা পুত্রবধূকে ত্যাগ করিতে হইলআর নবকুমারের সহিত তাঁহার স্ত্রীর সাক্ষা হইল না
স্বজনত্যক্ত ও সমাজচ্যুত হইয়া রামগোবিন্দ ঘোষাল অধিক দিন স্বদেশে বাস করিতে পারিলেন নাএই কারণেও বটে, এবং রাজপ্রসাদে উচ্চপদস্থ হইবার আকাঙ্ক্ষায়ও বটে, তিনি সপরিবারে রাজধানী রাজমহলে গিয়া বসতি স্থাপন করিতে লাগিলেনধর্ম্মান্তর গ্রহণ করিয়া তিনি সপরিবারে মহম্মদীয় নাম ধারণ করিয়াছিলেনরাজমহলে যাওয়ার পরে শ্বশুরের বা বনিতার কি অবস্থা হইল, তাহা নবকুমারের জানিতে পারিবার উপায় রহিল না এবং এ পর্য্যন্ত কখনও কিছু জানিতেও পারিলেন নানবকুমার বিরাগবশতঃ আর দারপরিগ্রহ করিলেন নাএই জন্য বলিতেছি, নবকুমারের এক সংসারওনহে
অধিকারী এ সকল বৃত্তান্ত অবগত ছিলেন নাতিনি বিবেচনা করিলেন, “কুলীনের সন্তানের দুই সংসারে আপত্তি কি?” প্রকাশ্যে কহিলেন, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলামএই যে কন্যা আপনার প্রাণরক্ষা করিয়াছে পরহিতার্থ আত্মপ্রাণ নষ্ট করিয়াছেযে মহাপুরুষের আশ্রয়ে ইহার বাস, তিনি অতি ভয়ঙ্করস্বভাবতাঁহার নিকট প্রত্যাগমন করিলে, আপনার যে দশা ঘটিতেছিল, ইহার সেই দশা ঘটিবেইহার কোন উপায় বিবেচনা করিতে পারেন কি না?”
নবকুমার উঠিয়া বসিলেনকহিলেন, “আমিও সেই আশঙ্কা করিতেছিলামআপনি সকল অবগত আছেন ইহার উপায় করুনআমার প্রাণদান করিলে যদি কোন প্রত্যুপকার হয় তবে তাহাতেও প্রস্তুত আছিআমি এমন সঙ্কল্প করিতেছি যে, আমি সেই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্মসমর্পণ করিতাহা হইলে ইহার রক্ষা হইবেঅধিকারী হাস্য করিয়া কহিলেন, “তুমি বাতুলইহাতে কি ফল দর্শিবে? তোমারও প্রাণসংহার হইবে অথচ ইহার প্রতি মহাপুরুষের ক্রোধোপশম হইবে নাইহার একমাত্র উপায় আছে
নব সে কি উপায়?
অধি আপনার সহিত ইহার পলায়নকিন্তু সে অতি দুর্ঘটআমার এখানে থাকিলে দুই এক দিনের মধ্যে ধৃত হইবেএ দেবালয়ে মহাপুরুষের সর্ব্বদা যাতায়াতসুতরাং কপালকুণ্ডলার অদৃষ্টে অশুভ দেখিতেছি
নবকুমার আগ্রহসহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার সহিত পলায়ন দুর্ঘট কেন?”
অধি এ কাহার কন্যা, – কোন্‌ কুলে জন্ম, তাহা আপননি কিছুই জানেন নাকাহার পত্নী, – কি চরিত্রা, তাহা কিছুই জানেন না! আপনি ইহাকে কি সঙ্গিনী করিবেন? সঙ্গিনী করিয়া লইয়া গেলেও কি আপনি ইহাকে নিজগৃহে স্থান দিবেন? আর যদি স্থান না দেন, তবে এ অনাথা কোথায় যাইবে?
নবকুমার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমার প্রাণরক্ষয়িত্রীর জন্য কোন কার্য্য আমার অসাধ্য নহেইনি আমার আত্মপরিবারস্থা হইয়া থাকিবেন
অধি ভালকিন্তু যখন আপনার আত্মীয় স্বজন জিজ্ঞাসা করিবে যে, এ কাহার স্ত্রী, কি উত্তর দিবেন?
নবকুমার পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আপনিই ইহার পরিচয় আমাকে দিনআমি সেই পরিচয় সকলকে দিব
অধি ভালকিন্তু এই পক্ষান্তরে পথ যুবক যুবতী অনন্যসহায় হইয়া কি প্রকারে যাইবে? লোকে দেখিয়া শুনিয়া কি বলিবে? আত্মীয় স্বজনের নিকট কি বুঝাইবে? আর আমিও এই কন্যাকে মা বলিয়াছি, আমিই বা কি প্রকারে ইহাকে অজ্ঞাতচরিত্র যুবার সহিত একাকী দূরদেশে পাঠাইয়া দিই?
ঘটকরাজ ঘটকালিতে মন্দ নহেন
নবকুমার কহিলেন, “আপনি সঙ্গে আসুন
অধি আমি সঙ্গে যাইব? ভবানীর পূজা কে করিবে?
নবকুমার ক্ষুব্ধ হইয়া কহিলেন, “তবে কি কোন উপায় করিতে পারেন না?”
অধি একমাত্র উপায় হইতে পারে সে আপনার ঔদার্য্যগুণের অপেক্ষা করে
নব সে কি? আমি কিসে অস্বীকৃত? কি উপায় বলুন?
অধি শুনুনইনি ব্রাহ্মণকন্যাইঁহার বৃত্তান্ত আমি সবিশেষ অবগত আছিইনি বাল্যকালে দুরন্ত খ্রীষ্টিয়ান তস্কর কর্ত্তৃক অপহৃত হইয়া যানভঙ্গপ্রযুক্ত তাহাদিগের দ্বারা কালে এ সমুদ্রতীরে ত্যক্ত হয়েনসে সকল বৃত্তান্ত পশ্চা ইঁহার নিকট আপনি সবিশেষ অবগত হইতে পারিবেনকাপালিক ইঁহাকে প্রাপ্ত হইয়া আপন যোগসিদ্ধিমানসে প্রতিপালন করিয়াছিলেনঅচিরা আত্মপ্রয়োজন সিদ্ধ করিতেনইনি এ পর্য্যন্ত অনূঢ়া; ইহার চরিত্র পরম পবিত্রআপনি ইঁহাকে বিবাহ করিয়া গৃহে লইয়া যানকেহ কোন কথা বলিতে পারিবে নাআমি যথাশাস্ত্র বিবাহ দিব
নবকুমার শয্যা হইতে দাঁড়াইয়া উঠিলেনঅতি দ্রুতপাদবিক্ষেপে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলেনকোন উত্তর করিলেন নাঅধিকারী কিয়ক্ষণ পরে কহিলেন,
আপনি এক্ষণে নিদ্রা যানকল্য প্রত্যুষে আপনাকে আমি জাগরিত করিবইচ্ছা হয়, একাকী যাইবেনআপনাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব
এই বলিয়া অধিকারী বিদায় হইলেনগমনকালে মনে মনে কহিলেন, “রাঢ়দেশের ঘটকালি কি ভুলিয়া গিয়াছি না কি?”

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks