Wednesday, October 3, 2012


ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : কাপালিকসঙ্গে
কথং নিগড়সংযতাসিদ্রুতম্‌
নয়ামি ভবতীমিতঃ – ”
রত্নাবলী
নবকুমার কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বারসংযোজনপূর্ব্বক করতলে মস্তক দিয়া বসিলেনশীঘ্র আর মস্তকোত্তলন করিলেন না
এ কি দেবী মানুষী না কাপালিকের মায়ামাত্র!নবকুমার নিস্পন্দ হইয়া হৃদয়মধ্যে এই কথার আন্দোলন করিতে লাগিলেনকিছুই বুঝিতে পারিলেন না
অন্যমনস্ক ছিলেন বলিয়া, নবকুমার আর একটি ব্যাপার দেখিতে পান নাইসেই কুটীরে তাহার আগমনপূর্ব্বাবধি একখানি কাষ্ঠ জ্বলিতেছিলপরে যখন অনেক রাত্রে স্মরণ হইল যে, সায়াহ্নকৃত্য অসমাপ্ত রহিয়াছে তখন জলান্বেষণ অনুরোধে চিন্তা হইতে ক্ষান্ত হইয়া এ বিষয়ের অসম্ভাবিতা হৃদয়ঙ্গম করিতেো পারিলেনশুধু আলো নহে, তণ্ডুলাদি পাকোপযোগী কিছু কিছু সামগ্রীও আছেনবকুমার বিস্মিত হইলেন না মনে করিলেন যে, এও কাপালিকের কর্ম্ম এ স্থানে বিস্ময়ের বিষয় কি আছে
নবকুমার সায়ংকৃত্য সমাপনান্তে তণ্ডুলগুলি কুটীরমধ্যে প্রাপ্ত এক মৃপাত্রে সিদ্ধ করিয়া আত্মসা করিলেন
পরদিন প্রভাতে চর্ম্মশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই সমুদ্রতীরাভিমুখে চলিলেনপূর্ব্বদিনের যাতায়াতের গুণে অদ্য অল্প কষ্টে পথ অনুভূত করিতে পারিলেনতথায় প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেনকাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন? পূর্ব্বদৃষ্টা মায়াবিনী পুনর্ব্বার সে স্থলে আসিবেন এমত আশা নবকুমারের হৃদয়ে কত দূর প্রবল হইয়াছিল বলিতে পারি না কিন্তু সে স্থান তিনি ত্যাগ করিতে পারিলেন নাঅনেক বেলাতেও তথায় কেহ আসিল নাতখন নবকুমার সে স্থানের চারিদিকে ভ্রমিয়া বেড়াইতে লাগিলেনবৃথা অন্বেষণ মাত্রমনুষ্য সমাগমের চিহ্নমাত্র দেখিতে পাইলেন নাপুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া সেই স্থানে উপবেশন করিলেনসূর্য্য অস্তগত হইল; অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল; নবকুমার হতাশ হইয়া কুটীরে ফিরিয়া আসিলেনসায়াহ্নকালে সমুদ্রতীর হইতে প্রত্যাগমন করিয়া নবকুমার দেখিলেন যে, কাপালিক কুটীরমধ্যে ধরাতলে উপবেশন করিয়া নিঃশব্দে আছেনবকুমার প্রথমে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন; তাহাতে কাপালিক কোন উত্তর করিল না
নবকুমার কহিলেন, “এ পর্য্যন্ত প্রভুর দর্শনে কি জন্য বঞ্চিত ছিলাম?” কাপালিক কহিল, “নিজ ব্রতে নিযুক্ত ছিলাম
নবকুমার গৃহগমনাভিলাষ ব্যক্ত করিলেন, কহিলেন, “পথ অবগত নহি পাথেয় নাই; যদ্বিহিতবিধান প্রভুর সাক্ষা পাইলেই হইতে পারিবে, এই ভরসায় আছি
কাপালিক কেবলমাত্র কহিল, “আমার সঙ্গে আগমন করএই বলিয়া উদাসীন গাত্রোত্থান করিলেনবাটী যাইবার কোন সদুপায় হইতে পারিবে প্রত্যাশায় নবকুমারও তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন
তখন সন্ধ্যালোক অন্তর্হিত হয় নাই কাপালিক অগ্রে অগ্রে, নবকুমার পশ্চা পশ্চা যাইতেছিলেনঅকস্মা নবকুমারের পৃষ্ঠদেশে কাহার কোমল করস্পর্শ হইলপশ্চা ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে স্পন্দহীন হইলেনসেই আগুল্‌ফলম্বিত-নিবিড়কেশরাশিধারিণী বন্যদেবীমূর্ত্তি! পূর্ব্বব নিঃশব্দ নিস্পন্দকোথা হইতে এ মূর্ত্তি অকস্মা তাঁহার পশ্চাতে আসিল! নবকুমার দেখিলেন, রমণী মুখে অঙ্গুলি প্রদান করিয়া আছেনবকুমার বুঝিলেন যে, রমণী বাক্যস্ফূর্ত্তি নিষেধ করিতেছে, নিষেধের বড় প্রয়োজন ছিল নানবকুমার কি কথা কহিবেন? তিনি তথায় চমকৃত হইয়া দাঁড়াইলেনকাপালিক এ সকল কিছুই দেখিতে পাইল না, অগ্রসর হইয়া চলিয়া গেলতাহারা উদাসীনের শ্রবণাতিক্রান্ত হইলে রমণী মৃদুস্বরে কি কথা কহিলনবকুমারের কর্ণে এই শব্দ প্রবেশ করিল,
কোথা যাইতেছ? যাইও নাফিরিয়া যাও পলায়ন কর
এই কথা সমাপ্ত করিয়াই উক্তিকারিণী সরিয়া গেলেন, প্রত্যুত্তর শুনিবার জন্য তিষ্ঠিলেন নানবকুমার কিয়কাল অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইলেন; পশ্চাদ্বর্ত্তী হইতে ব্যগ্র হইলেন, কিন্তু রমণী কোন্‌ দিকে গেল, তাহার কিছুই স্থিরতা পাইলেন নামনে করিতে লাগিলেন – “এ কাহার মায়া? না আমারই ভ্রম হইতেছেযে কথা শুনিলাম সে তো আশঙ্কাসূচক, কিন্তু কিসের আশঙ্কা? তান্ত্রিকেরা সকলই করিতে পারেতবে কি পলাইব? পলাইব বা কেন? সে দিন যদি বাঁচিয়াছি, আজিও বাঁচিবকাপালিকও মনুষ্য, আমিও মনুষ্য
নবকুমার এইরূপ চিন্তা করিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন, কাপালিক তাঁহাকে সঙ্গে না দেখিয়া প্রত্যাগমন করিতেছেকাপালিক কহিল, “বিলম্ব করিতেছ কেন?”
কাপালিক পুনরাহ্বান করাতে বিনা বাক্যব্যয়ে নবকুমার তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন
কিয়দ্দূর গমন করিয়া সম্মুখে এক মৃপ্রাচীরবিশিষ্ট কুটীর দেখিতে পাইলেনতাহাকে কুটীরও বলা যাইতে পারে, ক্ষুদ্র গৃহও বলা যাইতে পারেকিন্তু ইহাতে আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাইইহার পশ্চাতেই সিকতাময় সমুদ্রতীরগৃহপার্শ্ব দিয়া কাপালিক নবকুমারকে সেই সৈকতে লইয়া চলিলেন; এমত সময় তীরের তুল্য বেগে পূর্ব্বদৃষ্টা রমণী তাহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল; গমনকালে তাহার কর্ণে বলিয়া গেল, “এখনও পলাওনরমাংস নহিলে তান্ত্রিকের পূজা হয় না, তুমি কি জান না?”
নবকুমারের কপালে স্বেদনির্গম হইতে লাগিলদুর্ভাগ্যবশতঃ যুবতীর এই কথা কাপালিকের কর্ণে গেলসে কহিল, “কপালকুণ্ডলে!
স্বর নবকুমারের কর্ণে মেঘগর্জ্জনব ধ্বনিত হইলকিন্তু কপালকুণ্ডলা কোন উত্তর দিল না
কাপালিক নবকুমারের হস্ত ধারণ করিয়া লইয়া যাইতে লাগিলমানুষঘাতী করস্পর্শে নবকুমারের শোণিত ধমনীমধ্যে শতগুণ বেগে প্রধাবিত হইল লুপ্ত সাহস পুনর্ব্বার আসিলকহিলেন, “হস্ত ত্যাগ করুন
কাপালিক উত্তর করিল নানবকুমার পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমায় কোথায় লইয়া যাইতেছেন?”
কাপালিক কহিল, “পূজার স্থানে
নবকুমার কহিল, “কেন?”
কাপালিক কহিল, “বধার্থ
অতি তীব্রবেগে নবকুমার নিজ হস্ত টানিলেনযে বলে তিনি হস্ত আকর্ষিত করিয়াছিলেন, তাহাতে সামান্য লোকে তাঁহার হাত ধরিয়া থাকিলে হস্তরক্ষা করা দূরে থাকুক বেগে ভূপতিত হইতকিন্তু কাপালিকের অঙ্গমাত্রও হেলিল না, – নবকুমারের প্রকোষ্ঠ তাহার হস্তমধ্যেই রহিলনবকুমারের অস্থিগ্রন্থ যেন ভগ্ন হইয়া গেলনবকুমার দেখিলেন বলে হইবে নাকৌশলের প্রয়োজনভাল দেখা যাউক,” – এইরূপ স্থির করিয়া নবকুমার কাপালিকের সঙ্গে চলিলেন
সৈকতের মধ্যস্থানে নীত হইয়া নবকুমার দেখিলেন, পূর্ব্বদিনের ন্যায় তথায় বৃহ কাষ্ঠে অগ্নি জ্বলিতেছেচতুঃপার্শ্বে তান্ত্রিক পূজার আয়োজন রহিয়াছে, তন্মধ্যে নরকপালপূর্ণ আসব রহিয়াছে কিন্তু শব নাইঅনুমান করিলেন, তাঁহাকে শব হইতে হইবে
কতকগুলি শুষ্ক, কঠিন লতাগুল্ম তথায় পূর্ব্ব হইতেই আহরিত ছিলকাপালিক তদ্দ্বারা নবকুমারকে দৃঢ় বন্ধন করিতে আরম্ভ করিলনবকুমার সাধ্যমত বল প্রকাশ করিলেন; কিন্তু বল প্রকাশ কিছুমাত্র ফলদায়ক হইল নাতাঁহার প্রতীতি হইল যে, এ বয়সেও কাপালিক মত্ত হস্তীর বল ধারণ করেনবকুমারের বল প্রকাশ দেখিয়া কাপালিক কহিল,
মূর্খ! কি জন্য বল প্রকাশ কর? তোমার জন্ম আজি সার্থক হইলভৈরবীর পূজায় তোমার এই মাংসপিণ্ড অর্পিত হইবেক, ইহার অধিক তোমার তুল্য লোকের আর কি সৌভাগ্য হইতে পারে?”
কাপালিক নবকুমারকে দৃঢ় বন্ধন করিয়া সৈকতোপরি ফেলিয়া রাখিলেনএবং বধের প্রাক্কালিক পূজাদি ক্রিয়ায় ব্যাপৃত হইলেনততক্ষণ নবকুমার বাঁধন ছিঁড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু শুষ্ক লতা অতি কঠিন বন্ধন অতি দৃঢ়মৃত্যু আসন্ন! নবকুমার ইষ্টদেবচরণে চিত্ত নিবিষ্ট করিলেনএকবার জন্মভূমি মনে পড়িল, নিজ সুখের আলয় মনে পড়িল, একবার বহুদিন অন্তর্হিত জনক এবং জননীর মুখ মনে পড়িল, দুই এক বিন্দু অশ্রুজল সৈকত বালুকায় শুষিয়া গেলকাপালিক বলির প্রাক্কালিক ক্রিয়া সমাপনান্তে বধার্থ খড়্গ লইবার জন্য আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলকিন্তু যথায় খড়্গ রাখিয়াছিল তথায় খড়্গ পাইল নাআশ্চর্য্য! কাপালিক কিছু বিস্মিত হইলতাহার নিশ্চিত মনে হইতেছিল যে, অপরাহ্ণে খড়্গ আনিয়া উপযুক্ত স্থানে রাখিয়াছিল এবং স্থানান্তরও করে নাই, তবে খড়্গ কোথায় গেল? কাপালিক ইতস্ততঃ অনুসন্ধান করিলকোথাও পাইল নাতখন পূর্ব্বকথিত কুটীরাভিমুখ হইয়া কপালকুণ্ডলাকে ডাকিল, কিন্তু পুনঃ পুনঃ ডাকাতেও কপালকুণ্ডলা কোন উত্তর দিল নাতখন কাপালিকের চক্ষু লোহিত, ভ্রূযুগ আকুঞ্চিত হইলদ্রুতপদবিক্ষেপে গৃহাভিমুখে চলিলএই অবকাশে বন্ধনলতা ছিন্ন করিতে নবকুমার আর একবার যত্ন পাইলেন কিন্তু সে যত্নও নিষ্ফল হইল
এমত সময়ে নিকটে বালুকার উপর অতি কোমল পদধ্বনি হইল এ পদধ্বনি কাপালিকের নহেনবকুমার নয়ন ফিরাইয়া দেখিলেন, সেই মোহিনী কপালকুণ্ডলাতাঁহার করে খড়্গ দুলিতেছে
কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “চুপ! কথা কহিও না খড়্গ আমারই কাছে চুরি করিয়া রাখিয়াছি
এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা অতি শীঘ্রহস্তে নবকুমারের লতাবন্ধন খড়্গ দ্বারা ছেদন করিতে লাগিলেননিমিষমধ্যে তাঁহাকে মুক্ত করিলেনকহিলেন, “পলায়ন কর; আমার পশ্চা আইস, পথ দেখাইয়া দিতেছি
এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা তীরের ন্যায় বেগে পথ দেখাইয়া চলিলেননবকুমার লাফ দিয়া তাঁহার অনুসরণ করিলেন

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks