Wednesday, October 3, 2012


RE: উপন্যাসঃ চোখের বালি।। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

রাত্রে মহেন্দ্রের ভালো নিদ্রা হইল নাপ্রত্যুষেই সে বিহারীর বাসায় আসিয়া উপস্থিতকহিল, “ভাই, ভাবিয়া দেখিলাম, কাকীমার মনোগত ইচ্ছা আমিই তাঁহার বোনঝিকে বিবাহ করি

বিহারী কহিল, “সেজন্য তো হঠা নূতন করিয়া ভাবিবার কোনো দরকার ছিল নাতিনি তো ইচ্ছা নানাপ্রকারেই ব্যক্ত করিয়াছেন

মহেন্দ্র কহিল, “তাই বলিতেছি, আমার মনে হয়, আশাকে আমি বিবাহ না করিলে তাঁহার মনে একটা খেদ থাকিয়া যাইবে

বিহারী কহিল, “সম্ভব বটে

মহেন্দ্র কহিল, “আমার মনে হয়, সেটা আমার পক্ষে নিতান্ত অন্যায় হইবে

বিহারী কিঞ্চি অস্বাভাবিক উসাহের সহিত কহিল, “বেশ কথা, সে তো ভালো কথা, তুমি রাজি হইলে তো আর কোনো কথাই থাকে নাএ কর্তব্যবুদ্ধি কাল তোমার মাথায় আসিলেই তো ভালো হইত

মহেন্দ্রএকদিন দেরিতে আসিয়া কী এমন ক্ষতি হইল

যেই বিবাহের প্রস্তাবে মহেন্দ্র মনকে লাগাম ছাড়িয়া দিল, সেই তাহার পক্ষে ধৈর্য রক্ষা করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিলতাহার মনে হইতে লাগিল, ‘আর অধিক কথাবার্তা না হইয়া কাজটা সম্পন্ন হইয়া গেলেই ভালো হয়

মাকে গিয়া কহিল, “আচ্ছা মা, তোমার অনুরোধ রাখিববিবাহ করিতে রাজি হইলাম

মা মনে মনে কহিলেন, ‘বুঝিয়াছি, সেদিন মেজোবউ কেন হঠা তাহার বোনঝিকে দেখিতে চলিয়া গেল এবং মহেন্দ্র সাজিয়া বাহির হইল

তাঁহার বারংবার অনুরোধ অপেক্ষা অন্নপূর্ণার চক্রান্ত যে সফল হইল, ইহাতে তিনি সমস্ত বিশ্ববিধানের উপর অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিলেনবলিলেন, “একটি ভালো মেয়ে সন্ধান করিতেছি

মহেন্দ্র আশার উল্লেখ করিয়া কহিল, “কন্যা তো পাওয়া গেছে

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে কন্যা হইবে না বাছা, তাহা আমি বলিয়া রাখিতেছি

মহেন্দ্র যথেষ্ট সংযত ভাষায় কহিল, “কেন মা, মেয়েটি তো মন্দ নয়

রাজলক্ষ্মীতাহার তিন কূলে কেহ নাই, তাহার সহিত বিবাহ দিয়া আমার কুটুম্বের সুখ কী হইবে

মহেন্দ্রকুটুম্বের সুখ না হইলেও আমি দুঃখিত হইব না, কিন্তু মেয়েটিকে আমার বেশ পছন্দ হইয়াছে মা

ছেলের জেদ দেখিয়া রাজলক্ষ্মীর চিত্ত আরো কঠিন হইয়া উঠিলঅন্নপূর্ণাকে গিয়া কহিলেন, “বাপ-মা-মরা অলক্ষণা কন্যার সহিত আমার এক ছেলের বিবাহ দিয়া তুমি আমার ছেলেকে আমার কাছ হইতে ভাঙাইয়া লইতে চাও? এতবড়ো শয়তানি!

অন্নপূর্ণা কাঁদিয়া কহিলেন, “মহিনের সঙ্গে বিবাহের কোনো কথাই হয় নাই, সে আপন ইচ্ছামত তোমাকে কী বলিয়াছে আমিও জানি না

মহেন্দ্রের মা সে কথা কিছুমাত্র বিশ্বাস করিলেন নাতখন অন্নপূর্ণা বিহারীকে ডাকাইয়া সাশ্রুনেত্রে কহিলেন, “তোমার সঙ্গেই তো সব ঠিক হইয়াছিল, আবার কেন উলটাইয়া দিলেআবার তোমাকেই মত দিতে হইবেতুমি উদ্ধার না করিলে আমাকে বড়ো লজ্জায় পড়িতে হইবেমেয়েটি বড়ো লক্ষ্মী, তোমার অযোগ্য হইবে না

বিহারী কহিল, “কাকীমা, সে কথা আমাকে বলা বাহুল্যতোমার বোনঝি যখন, তখন আমার অমতের কোনো কথাই নাইকিন্তু মহেন্দ্র– ”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না বাছা, মহেন্দ্রের সঙ্গে তাহার কোনোমতেই বিবাহ হইবার নয়আমি তোমাকে সত্য কথাই বলিতেছি, তোমার সঙ্গে বিবাহ হইলেই আমি সব চেয়ে নিশ্চিন্ত হইমহিনের সঙ্গে সম্বন্ধে আমার মত নাই

বিহারী কহিল, “কাকী, তোমার যদি মত না থাকে, তাহা হইলে কোনো কথাই নাই

এই বলিয়া সে রাজলক্ষ্মীর নিকটে গিয়া কহিল, “মা, কাকীর বোনঝির সঙ্গে আমার বিবাহ স্থির হইয়া গেছে, আত্মীয় স্ত্রীলোক কেহ কাছে নাইকাজেই লজ্জার মাথা খাইয়া নিজেই খবরটা দিতে হইল

রাজলক্ষ্মীবলিস কী বিহারীবড়ো খুশি হইলামমেয়েটি লক্ষ্মী মেয়ে, তোর উপযুক্তএ মেয়ে কিছুতেই হাতছাড়া করিস নে

বিহারীহাতছাড়া কেন হইবেমহিনদা নিজে পছন্দ করিয়া আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করিয়া দিয়াছেন

এই-সকল বাধাবিঘ্নে মহেন্দ্র দ্বিগুণ উত্তেজিত হইয়া উঠিলসে মা ও কাকীর উপর রাগ করিয়া একটা দীনহীন ছাত্রাবাসে গিয়া আশ্রয় লইল

রাজলক্ষ্মী কাঁদিয়া অন্নপূর্ণার ঘরে উপস্থিত হইলেন; কহিলেন, “মেজোবউ, আমার ছেলে বুঝি উদাস হইয়া ঘর ছাড়িল, তাহাকে রক্ষা করো

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদি, একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকো, দুদিন বাদেই তাহার রাগ পড়িয়া যাইবে

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুমি তাহাকে জান নাসে যাহা চায়, না পাইলে যাহা-খুশি করিতে পারেতোমার বোনঝির সঙ্গে যেমন করিয়া হউক, তার– ”

অন্নপূর্ণাদিদি, সে কী করিয়া হয়বিহারীর সঙ্গে কথাবার্তা একপ্রকার পাকা হইয়াছে

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে ভাঙিতে কতক্ষণবলিয়া বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “বাবা, তোমার জন্য ভালো পাত্রী দেখিয়া দিতেছি, এই কন্যাটি ছাড়িয়া দিতে হইবে, এ তোমার যোগ্যই নয়

বিহারী কহিল, “না মা, সে হয় নাসে-সমস্তই ঠিক হইয়া গেছে

তখন রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণাকে গিয়া কহিলেন, “আমার মাথা খাও মেজোবউ, তোমার পায়ে ধরি, তুমি বিহারীকে বলিলেই সব ঠিক হইবে

অন্নপূর্ণা বিহারীকে কহিলেন, “বিহারী, তোমাকে বলিতে আমার মুখ সরিতেছে না, কিন্তু কী করি বলোআশা তোমার হাতে পড়িলেই আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হইতাম, কিন্তু সব তো জানিতেছই– ”

বিহারীবুঝিয়াছি কাকীতুমি যেমন আদেশ করিবে তাহাই হইবেকিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারোও সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না

বলিয়া বিহারী চলিয়া গেলঅন্নপূর্ণার চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল, মহেন্দ্রের অকল্যাণ-আশঙ্কায় মুছিয়া ফেলিলেনবার বার মনকে বুঝাইলেনযাহা হইল, তাহা ভালোই হইল

এইরূপ রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণা এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগূঢ় নীরব ঘাত-প্রতিঘাত চলিতে চলিতে বিবাহের দিন সমাগত হইলবাতি উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিল, সানাই মধুর হইয়া বাজিল, মিষ্টান্নে মিষ্টের ভাগ লেশমাত্র কম পড়িল না

আশা সজ্জিতসুন্দরদেহে লজ্জিতমুগ্ধমুখে আপন নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করিল; তাহার এই কুলায়ের মধ্যে কোথাও যে কোনো কণ্টক আছে, তাহা তাহার কম্পিত-কোমল হৃদয় অনুভব করিল না; বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয়া অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তাহার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় দূর হইয়া গেল

বিবাহের পর রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “আমি বলি, এখন বউমা কিছুদিন তাঁর জেঠার বাড়ি গিয়াই থাকুন

মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন মা

মা কহিলেন, “এবারে তোমার একজামিন আছে, পড়াশুনার ব্যাঘাত হইতে পারে

মহেন্দ্রআমি কি ছেলেমানুষনিজের ভালোমন্দ বুঝে চলিতে পারি না?

রাজলক্ষ্মীতা হোক-না বাপু, আর-একটা বসর বৈ তো নয়

মহেন্দ্র কহিল, “বউয়ের বাপ-মা যদি কেহ থাকিতেন, তাহাদের কাছে পাঠাইতে আপত্তি ছিল নাকিন্তু জেঠার বাড়িতে আমি উহাকে রাখিতে পারিব না

রাজলক্ষ্মী। (আত্মগত) ওরে বাস্‌ রে! উনিই কর্তা, শাশুড়ি কেহ নয়! কাল বিয়ে করিয়া আজই এত দরদ! কর্তারা তো আমাদেরও একদিন বিবাহ করিয়াছিলেন, কিন্তু এমন স্ত্রৈণতা, এমন বেহায়াপনা তো তখন ছিল না!

মহেন্দ্র খুব জোরের সহিত কহিল, “কিছু ভাবিয়ো না মাএকজামিনের কোনো ক্ষতি হইবে না 

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks