Wednesday, October 3, 2012


চতুর্থ পরিচ্ছেদ : স্তূপশিখরে
“ – সবিস্ময়ে দেখিলা অদূরে,
ভীষণ-দর্শন মূর্ত্তি
মেঘনাদবধ
যখন নবকুমারের নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন রজনী গভীরাএখনও যে তাঁহাকে ব্যাঘ্রে হত্যা করে নাই, ইহা তাঁহার আশ্চর্য্য বোধ হইলইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ব্যাঘ্র আসিতেছে কি নাঅকস্মা সম্মুখে বহু দূরে, একটা আলোক দেখিতে পাইলেনপাছে ভ্রম জন্মিয়া থাকে এজন্য নবকুমার মনোভিবিনিবেশপূর্ব্বক তপ্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেনআলোকপরিধি ক্রমে বর্দ্ধিতায়তন এবং উজ্জ্বলতর হইতে লাগিল আগ্নেয় আলোক বলিয়া প্রতীতি জন্মাইলপ্রতীতিমাত্র নবকুমারের জীবনাশা পুনরুদ্দীপ্ত হইলমনুষ্যসমাগম ব্যতীত এ আলোকের উপত্তি সম্ভবে না, কেন না, এ দাবানলের সময় নহেভাবিলেন, “ভাবিলেন এ আলোক ভৌতিক? – হইতেও পারে; কিন্তু শঙ্কায় নিরস্ত থাকিলেই কোন্‌ জীবন রক্ষা হয়?” এই ভাবিয়া নির্ভীকচিত্তে আলোক লক্ষ্য করিয়া চলিলেনবৃক্ষ, লতা, বালুকাস্তূপ পদে পদে তাঁহার গতিরোধ করিতে লাগিলবৃক্ষলতা দলিত করিয়া, বালুকাস্তূপ লঙ্ঘিত করিয়া নবকুমার চলিলেনআলোকের নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলেন যে, এক অত্যুচ্চ বালুকাস্তূপের শিরোভাগে অগ্নি জ্বলিতেছে, প্রভায় শিখরাসীন মনুষ্যমূর্ত্তি আকাশপটস্থ চিত্রের ন্যায় দেখা যাইতেছেনবকুমার শিখরাসীন মনুষ্যের সমীপবর্ত্তী হইবেন স্থির সঙ্কল্প করিয়া, অশিথিলীকৃত বেগে চলিলেনপরিশেষে স্তূপারোহণ করিতে লাগিলেনতখন কিঞ্চি শঙ্কা হইতে লাগিল তথাপি অকম্পিত পদে স্তূপারোহণ করিতে লাগিলেনআসীন ব্যক্তির সম্মুখবর্ত্তী হইয়া যাহা যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার রোমাঞ্চ হইলতিষ্ঠিবেন কি প্রত্যাবর্ত্তন করিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না
শিখরাসীন মনুষ্য নয়ন মুদ্রিত করিয়া ধ্যান করিতেছিল নবকুমারকে প্রথমে দেখিতে পাইল নানবকুমার দেখিলেন, তাহার বয়ঃক্রম প্রায় পঞ্চাশসর হইবেপরিধানে কোন কার্পাসবস্ত্র আছে কি না, তাহা লক্ষ্য হইল না; কটিদেশ হইতে জানু পর্য্যন্ত শার্দ্দূলচর্ম্মে আবৃতগলদেশে রুদ্রক্ষমালা; আয়ত মুখমণ্ডল শ্মশ্রুজটাপরিবেষ্টিতসম্মুখে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বলিতেছিল সেই অগ্নির দীপ্তি লক্ষ্য করিয়া নবকুমার সে স্থলে আসিতে পারিয়াছিলেননবকুমার একটা বিকট দুর্গন্ধ পাইতে লাগিলেন, ইহার আসনপ্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাহার কারণ অনুভূত করিতে পারিলেনজটাধারী এক ছিন্নশীর্ষ গলিত শবের উপর বসিয়া আছেনআরও সভয়ে দেখিলেন যে, সম্মুখে নরকপাল রহিয়াছে, তন্মধ্যে রক্তবর্ণ দ্রব পদার্থ রহিয়াছেচতুর্দ্দিকে স্থানে স্থানে অস্থি পড়িয়া রহিয়াছে এমন কি, যোগাসীনের কণ্ঠস্থ রুদ্রাক্ষমালামধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থিখণ্ডও গ্রথিত রহিয়াছেনবকুমার মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া রহিলেনঅগ্রসর হইবেন কি স্থান ত্যাগ করিবেন, তাহা বুঝিতে পারিলেন নাতিনি কাপালিকদিগের কথা শ্রুত ছিলেনবুঝিলেন যে, এ ব্যক্তি কাপালিক
যখন নবকুমার উপনীত হইয়াছিলেন, তখন কাপালিক মন্ত্রসাধনে বা জপে বা ধ্যানে মগ্ন ছিল, নবকুমারকে দেখিয়া ভ্রূক্ষেপও করিল নাঅনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিল, “কস্ত্বং?” নবকুমার কহিলেন, “ব্রাহ্মণ
কাপালিক কহিল, “তিষ্ঠএই কহিয়া পূর্ব্বকার্য্যে নিযুক্ত হইলনবকুমার দাঁড়াইয়া রহিলেন
এইরূপে প্রহরার্দ্ধ গত হইলপরিশেষে কাপালিক গাত্রোত্থান করিয়া নবকুমারকে পূর্ব্বব সংস্কৃতে কহিল, “মামনুসর
ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে, অন্য সময়ে নবকুমার কদাপি ইহার সঙ্গী হইতেন নাকিন্তু এক্ষণে ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রাণ কণ্ঠাগতঅতএব কহিলেন, “প্রভুর যেমত আজ্ঞাকিন্তু আমি ক্ষুধাতৃষ্ণায় বড় কাতরকোথায় গেলে আহার্য্য সামগ্রী পাইব অনুমতি করুন
কাপালিক কহিল, “ভৈরবীপ্রেরিতোঽসি; মামনুসর; পরিতোষঃ তে ভবিষ্যতি
নবকুমার কাপালিকের অনুগামী হইলেনউভয়ে অনেক পথ বাহিত করিলেন পথিমধ্যে কেহ কোন কথা কহিল নাপরিশেষে এক পর্ণকুটীর প্রাপ্ত হইল কাপালিক প্রথমে প্রবেশ করিয়া নবকুমারকে প্রবেশ করিতে অনুমতি করিল; এবং নবকুমারের অবোধগম্য কোন উপায়ে একখণ্ড কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালিত করিলনবকুমার তদালোকে দেখিলেন যে, ঐ কুটীর সর্ব্বাংশে কিয়াপাতায় রচিততন্মধ্যে কয়েকখানা ব্যাঘ্রচর্ম্ম আছে এক কলস জল ও কিছু ফলমূল আছে
কাপালিক অগ্নি জ্বালিত করিয়া কহিল, “ফলমূল যাহা আছে আত্মসা করিতে পারপর্ণপাত্র রচনা করিয়া কলসজল পান করিওব্যাঘ্রচর্ম্ম আছে, অভিরুচি হইলে শয়ন করিওনির্ব্বিঘ্নে তিষ্ঠ ব্যাঘ্রের ভয় করিও নাসময়ান্তরে আমার সহিত সাক্ষা হইবেযে পর্য্যন্ত সাক্ষা না হয়, সে পর্য্যন্ত এ কুটীর ত্যাগ করিও না
এই বলিয়া কাপালিক প্রস্থান করিলনবকুমার সেই সামান্য ফলমূল আহার করিয়া এবং সেই ঈষত্তিক্ত জল পান করিয়া পরম পরিতোষ লাভ করিলেনপরে ব্যাঘ্রচর্ম্মে শয়ন করিলেন, সমস্ত দিবসজনিত ক্লেশহেতু শীঘ্রই নিদ্রাভিভূত হইলেন

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment

Thnaks